প্রাথমিকের ৩৪ সমস্যা সমাধানে বসবে শিক্ষা সম্মেলন
নানা সংকটে জর্জরিত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রথমবারের মতো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজন করতে যাচ্ছে ডিপিও (প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা) সম্মেলন।
সম্মেলন উপলক্ষে গত ১৫ আগস্টের মধ্যে সকল প্রাথমিক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে জেলার সমস্যাগুলো লিখিতভাবে পাঠাতে বলা হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী সকলে নিজ নিজ জেলার স্কুলগুলোর সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তবে এখনও সম্মেলনের আয়োজনের সময় নির্ধারণ হয়নি।
তবে চলতি মাসের শেষের দিকে অথবা জুন মাসের প্রথম দিকে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা (ডিপিও) শিক্ষকশূন্যতা, শ্রেণিকক্ষ ও ভবন সংকট, জনবলের অভাব, পদোন্নতি বঞ্চিত, অপ্রতুল বরাদ্দ, প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ মোট ৩৪ ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করেছেন।
সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমে গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য দ্রুত শূন্যপদে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি নীতিমালা তৈরি, সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদসহ প্রশাসনিক নানা পদ সৃজন, স্কুলসূচি ও পরীক্ষা কমানো, মনিটরিং জোরদার, সবার জন্য উপবৃত্তি, অতিরিক্ত স্কুল ও কোচিং সেন্টার বন্ধ, উন্নয়ন কাজে শিক্ষকদের সম্পৃক্তসহ নানা সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত প্রথমবারের মতো ডিপিও সম্মেলন সেশন ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ের সমস্যা এবং তা সমাধানের জন্য ডিপিওদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রথমবারের মতো আয়োজিত সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে ডিপিওদের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। সমস্যা সমাধানের উপায়ও সম্মেলনে নির্ধারণ করা হবে। তবে এখনও সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ হয়নি বলে তিনি জানান।
মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়া ডিপিওদের প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শিক্ষক সংকটই গুণগত প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান অন্তরায়। দ্রুত সহকারী শিক্ষক থেকে পাঠপ্রশাসনের শূন্যপদে নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ কোটা বাদ দিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক নির্ধারণ, দুর্গম ও হাওর এলাকায় উপজেলা ভিত্তিক কোটা নির্ধারণ করে শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রধান শিক্ষক পদে দীর্ঘদিন পদোন্নতি বন্ধ থাকায় মাঠপর্যায়ে হতাশা বিরাজ করছে। স্কুল পরিচালনায় সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা। দ্রুত পদোন্নতি নীতিমালা সহজ করে ডিপিও বরাবর ন্যস্তের প্রস্তাব করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার জন্য স্কুলের সময়সূচি কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে শিক্ষকরা আগের মতো স্কুলে অবস্থান করে পাঠদানের প্রস্তুতি এবং অফিসিয়াল কার্যক্রম শেষ করবেন। দুপুরে টিফিনের সময় ৩০ মিনিটের পরিবর্তে ৪৫ মিনিট করা; প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য টিফিনের সময় চালু করা; বছরে তিনটির পরিবর্তে দুটি পরীক্ষা নেয়া; প্রতিটি অধ্যায়ের পাঠদান শেষে অধ্যয় ভিত্তিক ক্লাস টেস্ট নেয়া; প্রতিদিন ছয়টির পরিবর্তে চারটি বিষয় পাঠদান করা; ২৮ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত শিশু ভর্তির সময় নির্ধারণ; আনন্দদায়ক স্কুল গড়তে চারু-কারু, শারীরিক শিক্ষা ও সঙ্গীতের শিক্ষক নিয়োগ; ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ১:৩০ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে মিডডে মিল, স্কুল ফিডিং এবং উপবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব; অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা স্কুলের ছাত্রী, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি চালু; বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে যেসব স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০০ বা এর কম, সেসব স্কুল বিলুপ্ত করে শিক্ষকদের অন্য স্কুলে বদলি করা; স্কুল চলাকালীন কোচিং সেন্টার বন্ধ; কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন করে চালু করা প্রাক-প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণি এবং জাতীয়করণ করা স্কুলে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই। এছাড়া জাতীয়করণ করা স্কুলের অবকাঠামো জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে দ্রুত নতুন ভবন ও শ্রেণিকক্ষ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিবেশসম্মত ভবন নির্মাণের জন্য নীতিমালা করারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ রোধ, মাদক ও ইভটিজিং বিষয়ে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি (এসএমসি), অভিভাবকদের সচেতন করা; আন্তঃপ্রাথমিক বিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা; জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের বিদেশে শিক্ষা সফর; পরিবেশ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বৃক্ষ রোপন ও পুরস্কৃত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের ডিপিও মো. জাহিদুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, হাওর এলাকার স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দিলেও তারা বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। এ কারণে পদগুলো শূন্য থাক।
এ সংকট সমাধানের জন্য উপজেলা ভিত্তিক কোটা নির্ধারণ করে স্থানীয় প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব করেছি। আবাসিক স্কুল নির্মাণসহ স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি তুলে ধরেছি। আশা করছি সম্মেলনের মাধ্যমে সারা দেশের প্রাথমিক শিক্ষার সংকট দূর হবে।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ মার্চ মন্ত্রণালয় থেকে ডিপিও সম্মেলনের জন্য তথ্য চেয়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়। এতে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক, সংস্থাপন, উন্নয়ন, ডিজিটাল কার্যক্রম, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, প্রশিক্ষণ বিধিবিধান, নীতিমালা, উন্নয়নমূলক কাজ, ভবন নির্মাণ ও মেরামত, আইটি, শুদ্ধাচার, উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড, সরঞ্জামাদি, আর্থিক বিষয়াদি, স্কুল গ্রেডিং, স্কুল তদারকি, একাডেমিক সুপারভিশনে সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়ে ডিপিওদের কাছ থেকে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব চাওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তারা উল্লেখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
এমএইচএম/এমএআর/পিআর