লিটারে ২১ টাকাই যাচ্ছে ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলোর পকেটে
সয়াবিন তেলের বাজারে নৈরাজ্য চলছেই। দাম বাড়ালেও এখনো স্বাভাবিক হয়নি বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ। যদিও বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে। তবু নানান অজুহাতে দেশের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোক্তাকে জিম্মি করে গুটিকয়েক ভোজ্যতেল কোম্পানি নানান সুবিধা নিচ্ছে। তারা একদিকে সরকারের কাছ থেকে শুল্ক-কর ছাড়ের সুবিধা নিয়েছে, অন্যদিকে ভোক্তাপর্যায়ে দাম বাড়িয়ে অত্যধিক মুনাফা করছে।
এর আগে দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার দুই দফায় আমদানি শুল্ক কমায়। যাতে আগের চেয়ে প্রতি লিটারে ১১ টাকা কম খরচ হচ্ছে তেল আমদানিতে। এরপরও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। বাধ্য হয়ে গত ৯ ডিসেম্বর তাদের সঙ্গে সভা করে প্রতি লিটারে আট টাকা দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬৭ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৫ টাকায়। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৭ টাকা। খোলা পাম তেলের দাম ১৪৯ থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়েছে।
এতে শুল্ক ছাড় ও মূল্যবৃদ্ধি মিলিয়ে প্রতি লিটারে প্রায় ১৯ টাকা দাম বাড়িয়েছে তেল আমদানিকারক ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
অন্যদিকে খুচরা ব্যবসায়ীদেরও আগের চেয়ে বাড়তি দামে তেল কিনতে হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধির পর তাদের কাছ থেকে কোম্পানিগুলো অর্ডার (ডিউ) নিয়েছে। এখন যে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে তাতে প্রতি লিটারে খুচরা বিক্রেতার মুনাফা দুই টাকা কমানো হয়েছে। আগে প্রতি লিটার তেল বিক্রিতে খুচরা বিক্রেতার মুনাফা চার টাকা থাকলেও এখন সেটা দুই টাকা করা হয়েছে।
অর্থাৎ হিসাব বলছে, প্রতি লিটারে শুল্ক-কর ছাড়ের ১১ টাকা, মূল্যবৃদ্ধির আট টাকা ও খুচরা বিক্রেতার মুনাফার দুই টাকা মিলিয়ে মোট ২১ টাকা যাচ্ছে কোম্পানির পকেটে।
এ ব্যাপারে রামপুরার আল্লাহর দান ও তোপখানার শহিদ স্টোরের বিক্রেতারা জানিয়েছেন, আগে প্রতি লিটার তেল বিক্রি করে তাদের চার টাকা লাভ থাকতো। এখন এক লিটারের বোতলে দুই টাকা, দুই লিটারে চার টাকা ও পাঁচ লিটারের বোতলে সাত টাকা লাভ দিচ্ছে কোম্পানিগুলো।
এখন প্রতি টন সয়াবিন তেল এক হাজার ৯৯ ডলারে বিক্রি হচ্ছে, যা গত মাসে এক হাজার ৩০০ ডলার ছিল। বিশ্ববাজারের এক হাজার ৩০০ ডলার দামের ওপর ভিত্তি করেই সয়াবিনের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল কোম্পানিগুলো।
বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমছে
বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমছে। পণ্যের তথ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক পোর্টাল ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য বলছে, এখন প্রতি টন সয়াবিন তেল এক হাজার ৯৯ ডলারে বিক্রি হচ্ছে, যা গত মাসে এক হাজার ৩০০ ডলার ছিল।
এদিকে বিশ্ববাজারের এক হাজার ৩০০ ডলার দামের ওপর ভিত্তি করেই সয়াবিনের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল কোম্পানিগুলো। সেজন্য বাজারে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তারা। তখন সরকার বাধ্য হয়ে প্রতি লিটার তেলের দাম আট টাকা বাড়ানোর অনুমতি দেয়।
এরপরও সয়াবিন তেলের বাজার এখনো স্বাভাবিক হয়নি। বরং রমজান সামনে রেখে কোম্পানিগুলো বাজারে সরবরাহ কমিয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে তারা দাম আরও বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে বলে জানিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
- আরও পড়ুন
- সয়াবিন তেলের দাম বাড়লো লিটারে ৮ টাকা
- মিলছে না বোতলের সয়াবিন তেল, খোলা তেলে নৈরাজ্য
- ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট শক্তিশালী: অর্থ উপদেষ্টা
- দাম সহনীয় রাখতে ভোজ্যতেলে ভ্যাট-কর কমালো সরকার
- পাবনায় দেড় মাস ধরে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট
তেলের সঙ্গে অন্যান্য পণ্য নেওয়ার শর্ত
এখনো বাজারে বেশ কিছু দোকানে সয়াবিন তেল নেই। যেসব দোকানে আছে, সেখানেও দেখা গেছে স্বল্পতা। এক কোম্পানির তেল থাকলেও অন্য কোনো কোম্পানির তেল নেই। আবার কোথাও এক লিটারের বোতল থাকলেও দুই বা পাঁচ লিটারের বোতল নেই।
রামপুরা বৌবাজার এলাকায় আল্লাহর দান স্টোরের আবুল হোসেনের দোকানে কিছু সয়াবিন তেল মিলেছে। জানতে চাইলে দোকানি জানান, বেশ কয়েক সপ্তাহ বাদে একটি কোম্পানি তেল দিয়ে গেছে। আরও দুটি কোম্পানির অর্ডার দেওয়া আছে, তাদের কোনো হদিস নেই।
তিনি এ-ও জানান, যে কোম্পানি তেল দিয়েছে, তারা তেলের সঙ্গে অন্যান্য পণ্য নেওয়ার শর্তে দিয়েছে। অর্থাৎ তেল নেওয়ার জন্য ডাল ও চাপাতা নিতে হয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে।
এমন পরিস্থিতেতে খুচরা বিক্রেতারাও সয়াবিন তেলের বোতলের সঙ্গে ক্রেতাদের অন্যান্য পণ্য কেনার শর্ত দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সে বিষয়ে বিক্রেতারা বলছেন, কোম্পানির পরিবেশকেরাই তাদের এসব পণ্য কিনতে বাধ্য করছেন। তাই তারাও ক্রেতাদের তেলের সঙ্গে ওই সব পণ্য কেনার শর্ত আরোপ করছেন।
হাজিপাড়া বৌবাজার এলাকায় ক্রেতা ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘সয়াবিন তেলের পাঁচ লিটারের একটি বোতল কিনতে গেলে দোকানি অন্যান্য পণ্য নেবেন কিনা সেটা জিজ্ঞেস করেন। আমাকে একটি চায়ের প্যাকেট ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন। আমি সেটা নেইনি বলে তেল দেয়নি। পরে পরিচিত অন্য একটি দোকানে গিয়ে তেল কিনেছি।’
একই অবস্থা দেখা গেছে তোপখানা রোডেও। সেখানে শহিদ স্টোরের বিক্রেতা বলেন, অন্যান্য পণ্য বেশি করে অর্ডার না দিলে এখনো শুধু তেল দিচ্ছে না কোম্পানিগুলো।
‘বিশ্ববাজারে দাম কমছে এটা ঠিক। তবে সরকার যে ফর্মুলার মাধ্যমে আমাদের তেলের দাম সমন্বয় করে, সেটা থেকে এখনো বিশ্ববাজারের দাম বেশি। এছাড়া সয়াবিনের দাম কমলেও পাম তেলের দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে। এরও একটি প্রভাব পড়েছে।’- মোস্তফা হায়দার
কৃত্রিম সংকটের নেপথ্যে কী
বাজারে ভোজ্যতেলের সংকটের কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও টিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা হায়দার জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের বাজারে প্রতি মাসে দুই লাখ টন তেলের চাহিদা রয়েছে। সে সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি আছে। সেটা আমরা বাজারে দেখছি, পেপার পত্রিকায় খবর আসছে।’
তবে টিকে গ্রুপের তেল সরবরাহের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমরা (টিকে গ্রুপ) আগের মাসে আট থেকে নয় হাজার টন তেল সরবরাহ করতাম, এখন সেটা কমপক্ষে ১৮ হাজার টন করেছি। অর্থাৎ দ্বিগুণ হয়েছে। অন্য কোম্পানি কী করছে, এ প্রসঙ্গে আমার জানা নেই।’
বিশ্ববাজারে দাম কমা প্রসঙ্গে মোস্তফা হায়দার বলেন, ‘বিশ্ববাজারে দাম কমছে এটা ঠিক। তবে সরকার যে ফর্মুলার মাধ্যমে আমাদের তেলের দাম সমন্বয় করে, সেটা থেকে এখনো বিশ্ববাজারে দাম বেশি। এছাড়া সয়াবিনের দাম কমলেও পাম তেলের দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে। এরও একটি প্রভাব পড়েছে।’
‘বাজারে ৬০ শতাংশ পাম তেল, বাকিটা সয়াবিন। পাম তেলের দাম বাড়ায় সয়াবিনের ওপর চাপ পড়ছে, সেটাও সরবরাহ সংকটের একটি কারণ হতে পারে।’ জানান মোস্তফা হায়দার।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসন্ন রমজান মাসে ভোজ্যতেলের সরবরাহ ও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। এরই অংশ হিসেবে ভ্যাট ও অগ্রিম কর প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দামও এক রকম ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে বাড়ানো হয়েছে। তারপরও কোম্পানিগুলো নানান কৌশলে বাজার অস্থিতিশীল রেখেছে, যেটা মোটেও কাম্য নয়। তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতে ট্যারিফ কমিশনকে বলা হয়েছে।’
ট্যারিফ কমিশন দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা যাচাইয়ে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ এবং ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করেছে। তারা যৌক্তিক দাম পর্যালোচনা করছে বলেও জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় সয়াবিন তেল মজুত করে এখন কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। আবার তারাই বিক্রয় প্রতিনিধিদের দিয়ে গুজব ছড়িয়েছে যে, বাজারে তেল নেই। সয়াবিন তেল সরবরাহ দিচ্ছে না, বাধ্য হয়ে ভোক্তারা বেশি টাকায় তেল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘এত সুবিধা, দাম বাড়ানোর পরেও কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ বন্ধ রেখে ভোক্তাদের সঙ্গে নৈরাজ্য করছে। তাদের সরবরাহ ও মজুত খতিয়ে দেখা দরকার।’
গুটিকয়েক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরে ভোজ্যতেল শিল্পে কিছু পরিবর্তন এসেছে। এ বাজারের একটি বড় অংশীদার এস আলম গ্রুপ তেল সরবরাহ থেকে সরে গেছে। বর্তমানে ভোজ্যতেলের বাজারে ১০ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তবে নিয়ন্ত্রণ টিকে, সিটি, মেঘনা ও বসুন্ধরা গ্রুপের কাছে। এ চার কোম্পানি আমদানি করা ভোজ্যতেলের বাজারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে।
দেশে এখন বছরে ৩০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা। যার দুই-তৃতীয়াংশ এসব প্রতিষ্ঠান আমদানি করছে। বাকিটা দেশে উৎপাদনকারী ও অন্য প্রতিষ্ঠান আনছে। ফলে ভোজ্যতেলের বাজারে চলমান সংকটে এ চার প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করছেন কেউ কেউ।
এনএইচ/এসআইটি/এমএমএআর/জিকেএস