ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি নজর দিতে হবে স্থিতিশীলতার দিকে

মোঃ সামিউর রহমান সাজ্জাদ | প্রকাশিত: ১২:২৭ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রবৃদ্ধির চেয়ে এখন আমাদের বেশি নজর দিতে হবে স্থিতিশীলতা আনয়নের দিকে। সেটা করতে গেলে তিনটি মেজর চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা ও ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগে চাঞ্চল্য নিয়ে আসার দিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের কৃষিখাত অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেহেতু এটি খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষিখাতের বিভিন্ন নীতি সংস্কার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সার, কীটনাশক, বীজ ইত্যাদির সরবরাহ নিয়মিত করতে হবে।

সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোস্তাফিজুর রহমান। জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মো. সামিউর রহমান সাজ্জাদ

জাগো নিউজ: দেশের অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে?

মোস্তাফিজুর রহমান: অর্থনীতির বিভিন্ন মাত্রা আছে। পুঞ্জীভূত অনেক সমস্যা, চ্যালেঞ্জ নিয়েই অগ্রসর হতে হচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল করার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকখাতে বেশ কিছু সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে। যার মাধ্যমে বর্তমান অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

অন্যদিকে অনেক সমস্যা যা কি না চলে আসছিল এবং এখনো চলমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এর মধ্যে অন্যতম। যে কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে সরবরাহ চেইনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হচ্ছে। চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে পার্থক্য এজন্য দায়ী।

স্থানীয় বাজারে উৎপাদিত পণ্য, আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর, উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এই জায়গায় যে সরবরাহ চেইন আছে সেক্ষেত্রে এখনো অনেক ব্যত্যয় রয়েছে।

যদিও আমদানি শুল্ক কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এর প্রতিফলন এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় আরও একটু সময় লাগবে, বিশেষত সরবরাহ বৃদ্ধি করা, সময় মতো আমদানি করা, স্টক ভালোভাবে রাখা, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (টিসিবি) অন্যদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আরও কার্যকর করার ওপর নির্ভর করবে। এক্ষেত্রে এখনো বেশকিছু দুর্বলতা আমরা লক্ষ্য করছি।

‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চলমান যে পরিমাণ মুদ্রা আছে তার তুলনায় ২২ হাজার কোটি টাকা খুব বেশি নয়। সুতরাং এটা তেমন প্রভাব ফেলবে না’

জাগো নিউজ: খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবার ১৪ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিতে নতুন করে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে। এতে সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে কী প্রভাব পড়বে?

মোস্তাফিজুর রহমান: ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে এবং তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এটা আবার বন্ড দিয়ে উঠিয়ে নেওয়া হবে। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চলমান যে পরিমাণ মুদ্রা আছে তার তুলনায় ২২ হাজার কোটি টাকা খুব বেশি নয়। সুতরাং এটা তেমন প্রভাব ফেলবে না।

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত আছে। কিন্তু বাংলাদেশে মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুব কার্যকর হয় না। এখানে রাজস্ব নীতি বেশি কাজ করে। সেক্ষেত্রে চাল থেকে শুরু করে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে শুল্কহার কিছুটা কমানো হয়েছে, ফলে মূল্যস্ফীতি কমানো কিছুটা কার্যকর হবে। মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির সঙ্গে সমান্তরালভাবে সংযোগের মাধ্যমে যা আরও ত্বরান্বিত হবে।

সবচেয়ে বেশি যেটা করতে হবে তা হলো পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো, যা মধ্যমেয়াদি ব্যাপার। বিশেষ করে উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা, কৃষিপণ্য ও ভোগ্যপণ্য। সময়মতো আমদানি করা, স্টক করা যাতে করে মজুতের সুযোগ না থাকে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি, খবরদারি বাড়াতে হবে।

জাগো নিউজ: অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়নে সরকারি নথির তুলনায় প্রচারিত দৈনিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এটি কতটা যুক্তিযুক্ত?

মোস্তাফিজুর রহমান: এটা একদমই ঠিক না যে শ্বেতপত্র প্রণয়নে পত্রপত্রিকা বিশ্লেষণ করে করা হয়েছে। শ্বেতপত্রের বিভিন্ন কমিটি করা হয়েছিল। তারা বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র বিশ্লেষণ করেছেন। মেগা প্রকল্পের যে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি), সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (আরডিপিপি) কখনই উন্মুক্ত করা হয় না।

এসব প্রকল্পের কোন খাতে কী হয়েছে, অভ্যন্তরীণ রিটার্নের হার (আইআরআর), অর্থনৈতিক রেট অব রিটার্ন (ইআরআর), রিটার্নের আর্থিক হার (এফআরআর), নেট বর্তমান মূল্য (এনপিভি) ইত্যাদি উন্মুক্ত তথ্য নয়। এগুলো শ্বেতপত্র কমিটি অ্যাক্সেস করেছে। পাশাপাশি তারা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। কত টাকা পাচার হয়েছে সেটা খুঁজে বের করতে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারের কী হয়েছে যেগুলো আগে প্রকাশই করা যায়নি, সেগুলো তারা বের করে প্রকাশ করেছেন। সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিষেবা যেগুলোর সরকারি হিসাব আছে। এর বাইরে গিয়ে তারা হিসাব দিয়েছেন। কারণ সরকারের হিসাব ছিল অবনমিত হিসাব, প্রকৃত হিসাব ছিল না। সেটা পুনরায় হিসাব করা হয়েছে।

যেগুলো বাইরে থেকে হিসাব করা হয়েছে সেগুলোর অনেকগুলো তাদের নিজেদের কাজ। সংবাদপত্র তো আর গবেষণা করে প্রকাশ করেনি। সেগুলো তাদেরই গবেষণা থেকে নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। তাই এ যুক্তিটা ধোপে টিকে না।

‘বিনিয়োগের পরিস্থিতির ওপর বিভিন্ন ফ্যাক্টর কাজ করে। বিনিয়োগ পরিবেশ যেমন: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণেও ব্যবসায়ীরা এখনো অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। সেদিক থেকে ব্যবসায়ীদের যে জায়গাগুলোতে সমস্যা হচ্ছে সেগুলো সমাধান করতে হবে।’

জাগো নিউজ: বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৪০ মাসে সর্বনিম্ন। এভাবে কতদিন চলবে?

মোস্তাফিজুর রহমান: এটা একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার। আমরা যতগুলো সমস্যা আলোচনা করলাম এর সবটাই নির্ভর করবে বিনিয়োগের ওপর, বিশেষত বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপরে। আমরা দেখছি যে ঋণের সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ নীতি সুদহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায়ীরা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করছেন।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে চাহিদার ওপর প্রভাব পড়ছে। এর ফলেও ব্যক্তিখাত অনুৎসাহিত হচ্ছে। অর্থাৎ বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব সমস্যা বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এলসি খুলতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, ঋণপ্রাপ্তিতে অসুবিধা না হয়, ক্ষেত্রবিশেষে ব্যাংক-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের মাধ্যমে হলেও কিছুটা সাশ্রয়ী সুদে ঋণ পেতে পারেন।

প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি নজর দিতে হবে স্থিতিশীলতার দিকে

বিনিয়োগের পরিস্থিতির ওপর বিভিন্ন ফ্যাক্টর কাজ করে। বিনিয়োগ পরিবেশ যেমন: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণেও ব্যবসায়ীরা এখনো অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। সেদিক থেকে ব্যবসায়ীদের যে জায়গায় সমস্যা হচ্ছে সেগুলো সমাধান করতে হবে। এখন অনিশ্চয়তা তো আর কাগজে-কলমে ঠিক করা যায় না। এক্ষেত্রে আস্থা সৃষ্টি করতে হয়।

এখন কিছুটা অনিশ্চয়তা আছে যে নির্বাচন কবে হবে, এ সরকার কতদিন থাকবে। একটা রোডম্যাপ যদি হয়ে যায় তাহলে ব্যবসায়ীরা একটা আস্থার জায়গা পাবেন। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, এটা সত্য যে আমাদের কষ্ট অব ক্যাপিটাল বেড়েছে কিন্তু আরও যেসব জায়গায় তাদের খরচ বাড়ে যেমন: বিদ্যুৎ, জ্বালানি প্রাপ্যতা, পরিবহন খরচ ইত্যাদি জায়গায় তাদের সহায়তা করতে হবে। কারণ বিনিয়োগ যদি না বাড়ে তাহলে কিন্তু কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থায় খারাপ প্রভাব পড়বে।

‘আমাদের নির্ভরশীলতা আছে তাদের আমদানির ওপর। একইভাবে তাদেরও নির্ভরশীলতা আছে আমাদের দেশে রপ্তানির ওপরে। সুতরাং, সেখানে তাদেরও স্বার্থ আছে।’

জাগো নিউজ: আমদানি-রপ্তানিতে ভারতের সঙ্গে চলমান কূটনৈতিক অস্থিরতা কতটুকু প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: একটা রাজনৈতিক দিক তো আছেই। অর্থনৈতিক দিক আছে যেটা রাজনৈতিক দিকের কাছে হোস্টেজ হয়ে থাকে, সেটা আমি মনে করি না। ভারত থেকে আমরা ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করি, দুই বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করি। সেখানকার হাজার হাজার রপ্তানিকারক বাংলাদেশের বাজারের ওপর নির্ভরশীল।

আমাদের নির্ভরশীলতা আছে তাদের আমদানির ওপর। একইভাবে তাদেরও নির্ভরশীলতা আছে আমাদের দেশে রপ্তানির ওপরে। সুতরাং, সেখানে তাদেরও স্বার্থ আছে। আমরা তাদের থেকে তুলা, সুতা, কাপড় আমদানি করি। ফলে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হয়। আমরা অনেক ইন্টারমেডিয়ারি পণ্য আমদানি করি; ফলে আমাদের আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্প শক্তিশালী হয়। আমরা ভোগ্যপণ্য আমদানি করি সেখানে আমাদের ভোক্তার কল্যাণ হয়। ফলে তাদের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা আছে উৎপাদক, উদ্যোক্তা এবং ভোক্তাপর্যায়ে। কিন্তু তাদেরও নির্ভরশীলতা আছে আমাদের বাজারের ওপরে। এই জায়গায় যদি ব্যত্যয় হয় তাহলে অবশ্যই দুদিক থেকেই এটা ক্ষতিকারক হবে।

আমাদের বাজার বৈচিত্র্যকরণের দিকেও নজর দিতে হবে। কোভিডের সময় দেখা গেছে যে ভারত শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশে চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল। কিছুদিন আগে তাদের পেঁয়াজ উৎপাদন কম হয়েছিল। ফলে পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল। এ রকম অনেক দেশ নিজস্ব স্বার্থ অনুযায়ী অনেক ধরনের পদক্ষেপ নেয়।

এক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে বিকল্প যেসব জায়গা আছে সেগুলো সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখা, সেরকম ইঙ্গিত পেলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া। তবে আমরা আশা করব যদি চলমান রাজনৈতিক কোনো ধরনের সমস্যা থাকে, অর্থনীতিতে যাতে সেটার প্রতিফলন না হয়। কারণ দুদিকেরই স্বার্থ সেখানে আছে।

‘সরকারকে ব্যক্তিখাত উৎসাহিত ও প্রণোদিত করা উচিত; যাতে তারা আগাম আমদানি করে। যাতে বাজারে চাহিদা সরবরাহের পার্থক্য খুব বেশি না হয় এবং বাজারে এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে না বাড়ে।’

জাগো নিউজ: রমজান সামনে রেখে অন্যান্য বছর বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে নভেম্বর-ডিসেম্বরে ব্যাংকে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার ধুম পড়ে যেত। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ বছর সেরকম চাপ নেই। আপনার কী মনে হয়?

মোস্তাফিজুর রহমান: সরকারের এটা দায়িত্ব রমজানে যে সাত-আটটি পণ্য যেমন: সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, খেজুর, পেঁয়াজ ইত্যাদির চাহিদা বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এগুলো যাতে আমদানি করা হয়। এখন আমদানি তো সরকার করে না, করে ব্যক্তিখাত। সুতরাং, সরকারকে ব্যক্তিখাতকে উৎসাহিত ও প্রণোদিত করা উচিত, যাতে তারা আগাম আমদানি করে। যাতে বাজারে চাহিদা সরবরাহের পার্থক্য খুব বেশি না হয় এবং বাজারে এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে না বাড়ে। সেজন্য সরকারকে এখনই সুপরিকল্পিতভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশেষত ব্যক্তিখাত আমদানির ক্ষেত্রে তাদের কোনো ধরনের সমস্যা আছে কি না, এলসি খুলতে অসুবিধা হচ্ছে কি না, বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তিতে অসুবিধা হচ্ছে কি না, এসব ব্যাপারে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। না হলে পরে এটা বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করবে যেহেতু এসব পণ্যের চাহিদা রমজানের সময় বেড়ে যায়।

‘আগামী বছর নির্বাচন নিয়েও দৌড়ঝাঁপ শুরু হবে। ফলে অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারে যাতে সমস্যা না হয় সেটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নজরের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে। আমদানি এবং স্থানীয় আহরণের মাধ্যমে খাদ্যপণ্যের মজুত ঠিক রাখতে হবে।’

জাগো নিউজ: আগামী বছর অর্থনীতির এই অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে কী করতে হবে?

মোস্তাফিজুর রহমান: প্রবৃদ্ধির চেয়ে এখন আমাদের বেশি নজর দিতে হবে স্থিতিশীলতা আনয়নের দিকে। সেটা করতে গেলে তিনটি মেজর চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা এবং ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগে চাঞ্চল্য নিয়ে আসার দিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের কৃষিখাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে; যেহেতু এটি খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষি খাতের বিভিন্ন নীতি সংস্কার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সার, কীটনাশক, বীজ ইত্যাদির সরবরাহ নিয়মিত করতে হবে।

তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আমাদের আমদানি সময় মতো করার দিকে নজর দিতে হবে। আগামী বছর নির্বাচন নিয়েও দৌড়ঝাঁপ শুরু হবে। ফলে অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারে যাতে সমস্যা না হয় সেটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নজরের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে। আমদানি এবং স্থানীয় আহরণের মাধ্যমে খাদ্যপণ্যের মজুত ঠিক রাখতে হবে।

আমাদের রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এটি যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্য নতুন বাজার খোঁজা এবং পণ্য বৈচিত্র্যকরণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। যে সব প্রণোদনা দেওয়া হয় সেগুলো এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে বাজার এবং পণ্য বৈচিত্র্যকরণের দিকে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো ছিল। এটাও যাতে অব্যাহত থাকে এবং হুন্ডি, হাওয়ালার মধ্যে এটি যাতে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে না চলে যায় সেজন্য নজরদারি, খবরদারি বাড়াতে হবে। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি যে প্রাইভেট ক্রেডিটে কিছুটা চাঞ্চল্য আসছে। ক্যাপিটাল মেশিনারি এবং অন্য যেসব পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তা আমদানির ক্ষেত্রে কিছুটা চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। এটিকেও অব্যাহত রাখতে হবে।

আমদানিকারকের হাতে ডলারের সরবরাহ সময় মতো পৌঁছে দিতে হবে। তাহলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সবশেষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বাজার পর্যবেক্ষণে যাতে অনাহুত কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয় সেসব ক্ষেত্রেও আমাদের নজর দিতে হবে। আগামী বছরের দ্বিতীয় ভাগে নির্বাচনমুখী হাওয়া উঠবে। গণতান্ত্রিক রূপান্তরে সেটা প্রয়োজন। কিন্তু অর্থনীতির এই অগ্রাধিকারগুলো সেখানে রাখতে হবে এবং সংস্কার কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদন এর মধ্যে চলে আসবে। সেগুলোর বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।

মুদ্রানীতি কঠোর করা হয়েছে, যা চলমান। করছাড় পুনর্বিন্যাস করা দরকার। যে সব করছাড় বছরের পর বছর দেওয়া হয়েছে সেগুলো পুনর্বিবেচনা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু মুদ্রানীতি ও শুল্কনীতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসার পরিবেশ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস ঠিকমতো দিতে পারছে কি না, দেশীয় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য যা দরকার তা সরবরাহে কোনো সমস্যা যাতে না হয়, আমদানি স্তর থেকে উৎপাদক স্তরে যাতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা না হয়, সিন্ডিকেশন না হয়, চাঁদাবাজি না হয়, এগুলোও দেখতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে উৎপাদক এবং রপ্তানিমুখী কর্মকাণ্ড সহায়ক পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক আছে, হয়ত আরও কিছু সংকোচন করতে হতে পারে। রাজস্ব নীতির পুনর্বিন্যাস দরকার, প্রণোদনার পুনর্বিন্যাস দরকার, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তার সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সুশাসন, সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং কর্মকর্তা যারা আছেন তাদের কার্যক্রম যাতে ঠিক মতো করে, সংস্কার কর্মসূচি যেগুলো এখন বিভিন্ন কমিটি থেকে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর অন্তত বাস্তবায়ন, প্রথম কাজগুলো যাতে শুরু হয় সেগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ হবে না।

এসআরএস/এমএমএআর/এএসএম

আরও পড়ুন