এস আলমের কালো টাকা সাদা
বরখাস্ত সেই তিন কর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদকে চিঠি
ঘুসের বিনিময়ে ব্যাংক খাত ও আর্থিক খাতে জড়িত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম (এস আলম) দুই ছেলের আয়কর নথিতে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে আয়কর বিভাগের তিন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা হলেন- অতিরিক্ত কর কমিশনার সাইফুল আলম, যুগ্ম কর কমিশনার এ কে এম শামসুজ্জামান ও সহকারী কর কমিশনার মো. আমিনুল ইসলাম। বরখাস্ত হওয়া এ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)।
আইআরডির চিঠিসহ বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এস আলমের দুই ছেলে কালো টাকা সাদা করতেও পে-অর্ডার জালিয়াতি করেছেন। এ কাজে সহায়তা করেছেন ওই তিন কর্মকর্তা। তারা আয়কর নথি জালিয়াতির মাধ্যমে কর ফাঁকির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
এ ঘটনায় অভ্যন্তরীণ তদন্ত শেষ করেছে এনবিআর। সূত্র জানায়, এস আলমের কালো টাকাকাণ্ডে এনবিআর সদস্য (গ্রেড-১) সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। তবে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রকিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সোমবার তদন্ত কর্মকর্তা চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনের একটি কপি জাগো নিউজের সংগ্রহে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলমের দুই ছেলে আসাদুল আলম মাহির, আশরাফুল আলম ও তাদের মনোনীত প্রতিনিধি নিউটর চক্রবর্তী ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করতে গিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন কর্মকর্তারা। প্রতারণার মাধ্যমে ৭৫ কোটি টাকা কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। বিধি-বহির্ভূতভাবে এস আলমের দুই ছেলের অ-প্রদর্শিত ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করার মাধ্যমে ৭৫ কোটি টাকা কর ফাঁকির সঙ্গে তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার (বর্তমানে অতিরিক্ত কমিশনার) সাইফুল আলম, তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার (বর্তমানে অতিরিক্ত কমিশনার) এ কে এম শামসুজ্জামান এবং তৎকালীন অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (বর্তমানে সহকারী কর কমিশনার) আমিনুল ইসলাম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরখাস্ত কর্মকর্তা এ কে এম শামসুজ্জামান তদন্ত কর্মকর্তার কাছে স্বীকার করেন, তৎকালীন কর কমিশনার (কর অঞ্চল ১, চট্টগ্রাম) আবু দাউদ বাঘ ও কুমিরের ভয় দেখিয়ে তথ্য তলব ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা (১২০ ধারা) কার্যক্রম স্থগিত করতে বাধ্য করেন। শামসুজ্জামান জানান, তৎকালীন কর কমিশনারের চাপে পড়ে তিনি ১২০ ধারা কার্যক্রম স্থগিত করেছেন।
এছাড়া এতবড় একটি অপকর্ম আবু দাউদের অজ্ঞাতসারে ঘটেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এও বলা হয়, লিখিত বক্তব্যে শামসুজ্জামান বিষয়টি উল্লেখ করেননি। কোনো অদৃশ্য কারণে তিনি প্রকৃত সত্য উপস্থাপন করেননি।
যদিও আবু দাউদ তার লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছেন, অভিযোগ সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। এনবিআর সদস্য আবু দাউদ বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা ১১ জনের বক্তব্য নিয়েছেন। কিন্তু কেউ লিখিত বক্তব্যে আমার সম্পৃক্ততা উল্লেখ করেননি। এক কর্মকর্তা মৌখিকভাবে উল্লেখ করায় প্রতিবেদনে যেভাবে আমাকে দায়ী করা হয়েছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তিনি বলেন, প্রতিবেদনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। রিটার্ন জমা পড়েছে আমার আগে দায়িত্বরত কমিশনারের সময়ে। আর সেটা নিষ্পত্তি হয়েছে পরবর্তী কমিশনারের সময়ে। তাহলে শুধু আমাকে একা কেন দায়ী করা হলো? সার্কেল অফিসারের অপকর্মের দায়ভার কি শুধু আমাকে একা নিতে হবে। তাছাড়া সার্কেল অফিসার করদাতার সঙ্গে যোগসাজশে কী অপকর্ম করলো, তার দায়ভার কি কমিশনারের ওপর বর্তানো উচিত? যদি বর্তায়, তাহলে দেশের সব কর অঞ্চলের কমিশনারের নামে এ ধরনের অভিযোগ আনা যাবে।
অনিয়ম করতে ব্যাংকের তথ্য ম্যানুপুলেট
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনিয়ম করতে আয়কর নথির সব রেকর্ডপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজন করেছে এস আলমের দুই ছেলে। তারা তাদের পরিবারের মালিকানাধীন ব্যাংকের আইটি সিস্টেম ম্যানুপুলেট করে তিনটি ব্যাংক হিসেবে ভুয়া তথ্য সন্নিবেশিত করেছেন।
সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যাংক কর্মকর্তাদের চাপ দিয়ে পে-অর্ডারের তারিখ পরিবর্তন করান এস আলমের দুই ছেলে। ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ২৫ কোটি টাকা করে দুই পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। যদিও ব্যাংক মালিকদের চাপের কারণে তারিখ দেওয়া হয় ২৯ জুন। ২০ ডিসেম্বর ওই দুটি পে-অর্ডার ফেরত দেওয়া হলে নতুন দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। এক্ষেত্রেও মালিকপক্ষ থেকে চাপ দিয়ে ১৮ অক্টোবর তারিখ দিতে বাধ্য করে। এমনকি আয়কর অফিস থেকে পে-অর্ডার দুটি ২৯ জুন ইস্যু করা হয়েছিল কি না জানতে চাওয়া হয়। ব্যাংক থেকে তখন জানানো হয়, পে-অর্ডার দুটি সঠিক এবং শাখা থেকে ইস্যু করা হয়েছে।
এসএম/এমএএইচ/জিকেএস