ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ

কারখানাকেন্দ্রিক আধিপত্যের লড়াই, ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন

ইয়াসির আরাফাত রিপন , ইব্রাহীম হুসাইন অভি | প্রকাশিত: ০৫:১৬ পিএম, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে কারখানাকেন্দ্রিক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় শ্রমিকদের ব্যবহার করে পরিস্থিতি অস্থিশীল করার চেষ্টা করছে একটি মহল। এতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন ও শৃঙ্খলা। দেশের রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গার্মেন্টস শিল্পমালিক এবং শ্রমিক নেতারা।

জানা গেছে, অব্যাহত শ্রমিক আন্দোলনের মুখে সাভার ও আশুলিয়ায় বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে মালিকপক্ষ। এ নিয়ে ওই এলাকায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জেও। রোববার বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পলাশবাড়ী এলাকা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা।

অন্যদিকে আজ সোমবার চাকরি স্থায়ীকরণ, বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবিতে গাজীপুরে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। এদিন সকাল থেকে চান্দনা চৌরাস্তা, ভোগরা, নাওজোর, কোনাবাড়ী, বোর্ডবাজার ও টঙ্গীতে বিক্ষোভ করেন তারা।

শ্রমিকরা জানান, গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শুধু নারী শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন পুরুষ শ্রমিকরা। তাই কারখানাগুলোতে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার জন্য দাবি জানিয়ে সকাল থেকেই বিভিন্ন কারখানার চাকরিবঞ্চিত পুরুষরা সড়কে নেমে আসেন।

গাজীপুরের গাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল ইসলাম বলেন, সকাল থেকে শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।

কারখানা কেন্দ্রিক আধিপত্যের লড়াই, ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন

অন্যদিকে টঙ্গী এলাকার বাটা সু কোম্পানির শ্রমিকরা চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এছাড়া গাজীপুর চন্দনা চৌরাস্তা ও ভোগরা বাইপাস এলাকায় পোশাক কারখানার পুরুষ শ্রমিকরা তাদের দাবি জানিয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে ১০ দফা দাবিতে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শ্রমিকরা। সোমবার সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তারা নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের মোজারমেইল এলাকায় অবস্থান নিয়ে অবরোধ করেন। এ সময় মহাসড়কটিতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারখানার এক শ্রমিক জাগো নিউজকে বলেন, এলাকায় প্রভাব বিস্তার করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গ্রুপ থাকে। ক্ষমতার পালাবদলের পর তারা নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য শ্রমিকদের ব্যবহার করছেন। দেশে এটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। এতদিন আওয়ামী লীগের লোকজন কাজ করতেন, এখন পরিবর্তনের পর সেটা অন্য কেউ করবে। যেসব এলাকায় কারখানা আছে সেখানকার লোকাল কিছু লোক থাকেন যারা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। যেমন- ঝুটের ব্যবসা, খাবার ও অন্য সামগ্রী সরবরাহ।

তিনি বলেন, যেহেতু রাজনৈতিক একটা পরিবর্তন এসেছে এবং এতদিন যারা বঞ্চিত ছিলেন তারা নতুন করে তাদের অবস্থা জানান দিতে চাচ্ছেন। ফলে শ্রমিকদের ভুল বুঝিয়ে এ ধরনের আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ গার্মেন্টস শিল্প দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বিদেশি মুদ্রা জোগানদাতা। এখানে সমস্যা হলে অর্থনীতি সমস্যায় পড়বে। দ্রুত সময়ের মধ্যে কারা এর সঙ্গে জড়িত এবং তাদের দাবি-দাওয়া যদি যৌক্তিক হয় তার সমাধান করা। একই সঙ্গে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে যে ধরনের আন্দোলন চলছে, আমার মতে তা শ্রমিক আন্দোলন নয়। কারণ এই মুহূর্তে শ্রমিকদের তেমন কোনো আন্দোলন দাবি-দাওয়া নেই। যদি কোনো দাবি থাকেও তাহলে সেটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। বর্তমান অবস্থায় কোনোভাবেই আন্দোলন করা শ্রমিক এবং শিল্পের জন্য সমীচীন নয়। অন্য কেউ যেন কোনো ধরনের সুযোগ না নিতে পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনকে ত্বরিত গতিতে পদক্ষেপ নিয়ে এর সমাধান করতে হবে।

আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর এসপি মোহাম্মদ সারোয়ার আলম জানান, এ মুহূর্তে সেখানে জিএবি লিমিটেডসহ স্নোটেক্স, স্টারলিং গ্রুপ, নাসা অ্যাপারেলস ও একমি অ্যাগ্রোভেট অ্যান্ড কনজ্যুমারস লিমিটেডের কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন।

কারখানা কেন্দ্রিক আধিপত্যের লড়াই, ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন

গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান আহাম্মেদ বলেন, শ্রমিকদের বুঝিয়ে মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

শ্রমিকদের আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলেন শ্রমিক নেতা ও সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার। তিনি বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে শ্রমিকের কিছু যৌক্তিক দাবি থাকে এবং সেগুলো পূরণ করা উচিত। কিন্তু এই সময়ের বিষয় (আন্দোলন) ক্লিয়ার নয়। আমি মনে করি দাবি থাকলে সেটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত।

আরও পড়ুন

তিনি বলেন, অনেক জায়গায়ই দেখা যায়, স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক থাকে, সেক্ষেত্রে তারা শ্রমিকদের ভুলভাবে ব্যবহার করছে কি না সেটা দেখতে হবে। যেহেতু বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ, অনেকে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের সেক্টর যেন ধ্বংস না হয়, শ্রমিকরা যেন বেকার না হয়, সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে এবং সত্যটা সামনে এনে পরিস্থিতি মোকাবিলা ও সমাধান করতে হবে।

এ বিষয়ে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহিল রাকিব জাগো নিউজকে বলেন, এ আন্দোলন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতার লড়াই। এর একটা হলো ঝুটের ব্যবসা দখল, অন্যটি আওয়ামী লীগের শোডাউন দেখানো যে তারা মাঠে আছে। এখানে সাধারণ শ্রমিকদের তেমন কোনো দাবি-দাওয়া নেই। তবে এক জায়গায় বলা হচ্ছে শ্রমিক ছেলে-মেয়ে ফিফটি ফিফটি করতে হবে। আন্দোলনকারীদের একটা অংশ কারখানায় গিয়ে বলছেন ছেলেরা বসে আছে আর মেয়েদের কাজ দিচ্ছেন, এটা হতে পারে না। কিন্তু তারা জানেনই না যে, মেয়েদের হাতের টেইলারিং কাজ পুরুষরা করতে পারবেন না।

তিনি বলেন, আন্দোলনে দুটি গ্রুপ আসছে। এর একটি হলো যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে তারা আন্দোলনে আসছে, অপর গ্রুপটি হলো রাজনৈতিকভাবে মোটিভেটেট হয়ে আসছে। আমার কারখানায়ও দেখেছি কিছু লোক আসছে যারা হেলমেট পরা, লুঙ্গি পরা, স্যান্ডো গেঞ্জি পরা। কিশোর গ্যাং টাইপের কিছু লোক দেখা গেছে। লোকাল নেতার আহ্বানে তারা এসেছে, প্রভাব বিস্তার করতে চান তারা।

এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, একটি সংস্থা আমাদের সতর্ক করেছিল যে কারখানাগুলোয় থ্রেট আসতে পারে। সেই সতর্কতা এখন দৃশ্যমান। আন্দোলন ও প্রভাব বিস্তারকারীদের কারা অর্থায়ন করছে সেটা দেখার বিষয়। সবাই মিলে এই পরিস্থিতি প্রতিহত করতে হবে। আমরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে বসছি, সরকারকেও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রমিকদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে যেন কোনো অপ্রীতিকর পরিবেশ তৈরি করতে না পারে সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। দেশের ও অর্থনীতির স্বার্থে শ্রমিকদের বাঁচাতে হবে, কারখানাও সচল রাখতে হবে।

আইএইচও/ইএআর/ইএ/এমএস