এনবিআরে সংস্কার
দুর্নীতি বড় চ্যালেঞ্জ, পুরো অটোমেশনেই সমাধান
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিশেষ বিশেষ শিল্পগ্রুপকে সুবিধা দেওয়া, অটোমেশন করতে না পারা ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে সংস্কারের কথা বলেছেন প্রায় সবাই। তবে তা আলোচনাতেই থেকেছে। অদৃশ্য কারণে এনবিআরে প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, এনবিআরে অটোমেশন ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বন্ধ করাই সংস্কারের পথে বড় চ্যালেঞ্জ।
সম্প্রতি ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চেহারা পাল্টানোর চেষ্টা করছে এনবিআর। প্রতিষ্ঠানটিতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এনবিআরে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কর ফাঁকি প্রতিরোধে আলোচিত শিল্পগ্রুপ এস আলম, বেক্সিমকোসহ ছয়টি বড় প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে সংস্থাটি। কর ফাঁকিবাজদের ধরতে বড় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সংস্থাটি। নিজ প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বন্ধ করতে কড়া বার্তা দিয়েছেন এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে কর-জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে কম বাংলাদেশে, ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। কর জিডিপির এই হার সোমালিয়া বা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর কাছাকাছি। ১০ শতাংশের কম কর-জিডিপির অনুপাত নিয়ে উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণ সম্ভব নয়।
তিনি বলেছেন, সংস্কারের পদক্ষেপ হিসেবে এনবিআরকে স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেশন করা হবে। কেউ যদি নিয়মনীতি না মানেন তাহলে তাকে এনবিআর ছাড়তে হবে।
১২ বছর ধরে হয়নি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন
বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পরও রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। বরং ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কমিয়ে ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। সেখানে আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট সব মিলিয়ে আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। এর আগের ১১টি অর্থবছরও গেছে একই ধারায়।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও এনবিআরকে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা থাকায় চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
চলতি বছরের শুরুতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) জানায়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে কর-জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে কম বাংলাদেশে, ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। কর জিডিপির এই হার সোমালিয়া বা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর কাছাকাছি। ১০ শতাংশের কম কর-জিডিপির অনুপাত নিয়ে উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণ সম্ভব নয়।
‘একজন এআরও কাপড় ধরে বলছে এটাতে ২ শতাংশ নয়, ৫ শতাংশ ইলাস্টিসিটি আছে। এটা বলে সে কাপড় আটকে দিলো। আমি তখন বললাম, আমি ২০-২২ বছর ব্যবসা করি। ঈদের দিনও আমি কাপড় পরীক্ষা করি। আমি বলতে পারি না কাপড়ে ইলাস্টিসিটি ২ আছে না ৫! এভাবে পণ্য আটকে আমাদের হয়রানি করে।’-বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান
কর-জিডিপি ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ জাগো নিউজকে বলেন, বরাবরই রাজস্ব আদায়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। সেটা অর্জনে এনবিআরের সক্ষমতা আছে কি না তা দেখা হয় না। অন্যদিকে কর-জিডিপি অনুপাত সবসময়ই নিম্ন পর্যায়ের আশপাশেই ঘুরছে। এক্ষেত্রে এনবিআরে পদ্ধতিগত, অবকাঠামোগত ত্রুটি দূর করতে হবে।
পিআরআইয়ের গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক বলেন, অজ্ঞতা ও হয়রানির আশঙ্কায় অনেকেই রিটার্ন জমা দেন না। অটোমেশনের মাধ্যমে রিটার্ন আদায় বাড়ানো সম্ভব।
- আরও পড়ুন
- কর-জিডিপি বাড়াতে হবে, সারাক্ষণ ঋণ নিয়ে চলতে পারবো না
- বেক্সিমকো-সামিটসহ ৫ গ্রুপের মালিকদের লেনদেনের তথ্য চেয়ে চিঠি
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো সেবা বাড়াতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানো প্রয়োজন। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কর কাঠামো বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহায়ক করতে হবে। কর প্রশাসনকে শক্তিশালী এবং এনবিআরের কার্যক্রম প্রযুক্তিনির্ভর করাসহ প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংস্কার ও অটোমেশন হলে প্রতিষ্ঠানটিতে কর সংক্রান্ত দুর্নীতি কমবে। কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, বাস্তবসম্মত, ব্যবসাবান্ধব ও আধুনিক রাজস্ব বোর্ড চাই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে প্রতিষ্ঠানটিতে ঠিকমতো অটোমেশনই হয়নি। বিদ্যমান নীতিমালার সংশোধন নয়, আমরা আধুনিক নীতিমালা চাই।
এনবিআরের পুরাতন আইনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হয় এবং কিছু অসাধু কর্মকর্তা এতে লাভবান হন জানিয়ে পোশাক খাতের এই ব্যবসায়ী বলেন, কিছুদিন পর পর পণ্যের হারমোনাইজড সিস্টেম (এইচএস) কোড পরিবর্তন করে আমাদের বিপদে ফেলা হয়। মনে করেন, একটা পণ্যের ৮ ডিজিটের একটা এইচএস কোড ছিল। সেটাকে পরিবর্তন করা হলো। আমার আইনে আছে, এটাকে দেশের আইনে অনুমতিও দেওয়া আছে। কিন্তু যখন এনে ফেলা হয়, তখন বলা হয় এটা আপনার এইচএস কোডে নেই। আমার সফটওয়্যার আছে, পোর্টে সব কিছু দেখা হচ্ছে। আমি যদি অন্যায় করি আমাকে শাস্তি দেন। কিন্তু এইচএস কোডের মাধ্যমে এটাকে জটিল করা হচ্ছে। এগুলো করা হয় ঘুস খাওয়ার জন্য।
আরেকটি উদাহরণ দিয়ে ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘একজন এআরও বা সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা অনেক সময় অ্যাসেসমেন্টের নামে হয়রানি করে। একবার একজন এআরও কাপড় ধরে বলছে এটাতে ২ শতাংশ নয়, ৫ শতাংশ ইলাস্টিসিটি আছে। এটা বলে সে কাপড় আটকে দিলো। আমি তখন বললাম, আমি ২০-২২ বছর ব্যবসা করি। ঈদের দিনও আমি কাপড় পরীক্ষা করি। আমি বলতে পারি না কাপড়ে ইলাস্টিসিটি ২ আছে না ৫! এভাবে পণ্য আটকে আমাদের হয়রানি করে।’
- আরও পড়ুন
- কালো টাকা সাদা করার বিধানটি বাদ যাওয়া উচিত ছিল
- ‘দলীয়করণে অকার্যকর’ দুদক-এনবিআর ঢেলে সাজানোর পরামর্শ টিআইবির
জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এনবিআরকে জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব করতে হবে। সেটা করতে গেলে এনবিআরের কর আদায়ের পদ্ধতির অটোমেশন দরকার। অনেক জায়গায় এনবিআরের বিবেচনামূলক ক্ষমতা আছে, সেগুলো কমানো দরকার। কর আদায়ের প্রক্রিয়াটা সহজ করা হলে ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী সবাই কর দিতে আগ্রহী হবে। এর ফলে সরকারের কর রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সিনিয়র গবেষক ড. মাহফুজ কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখনই সুযোগ পুরো এনবিআরকে অটোমেশন করার। এটা আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। প্রতিষ্ঠানটির কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তাদের হাতে থাকা বিবেচনামূলক ক্ষমতা ইচ্ছামতো ব্যবহার করে হয়রানি করেন। এতে রাজস্ব প্রদানে অনেকেই আগ্রহ দেখান না। অটোমেশন হলে এই হয়রানিটা অনেকাংশে কমে যাবে। এই অটোমেশনটা করে ফেললে রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাও সম্ভব হবে। ইএফডিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারলে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভ্যাট আদায় সম্ভব হবে।’
মাহফুজ কবির বলেন, রাজস্ব বোর্ডের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প প্রণয়ন করা প্রয়োজন। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংস্থাটি কী চিন্তা করছে সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। এনবিআর নিয়ে নানান নেতিবাচক কথা প্রচলিত আছে। এনবিআরে আস্থার সংকটও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি স্টেকহোল্ডার ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির যে দূরত্ব রয়েছে সেটা কমিয়ে আনতে হবে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে পেপারলেস ও ফেসলেস করা গেলে মানুষের আস্থা ফিরবে। সেবা সহজীকরণ, মানোন্নয়ন, রাজস্ব আহরণের উদ্দেশ্যে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডাটা ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে এই অটোমেশন সম্ভব। করদাতা যদি ডোর টু ডোর সেবা পান, সব কাজ যদি ডিজিটালাইজেশন হয়ে যায়, তাহলে মানুষের ভোগান্তি অনেকটা কমে যাবে। কর ফাঁকিবাজদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কর ফাঁকিবাজরা পার পেয়ে যায়, এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলেই মূল সংস্কারটা হবে।
চলতি বছরের মাঝামাঝি একটি ছাগল কেনাকে কেন্দ্র করে এনবিআরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মতিউরের নাম সামনে আসে। এরপর এনবিআর কর্মকর্তা এনামুল, আবু ফয়সাল ও আরজিনার মতো শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও এসেছে দুর্নীতির অভিযোগ। গত এক দশকে ঢাকা কাস্টমসের ভল্ট থেকে স্বর্ণ চুরি ও এসাইকুডা জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে। এসব অনিয়মে ভাবমূর্তি হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সংস্কার করতে হলে এসব ঘটনার বিচার হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নতুন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানও প্রতিষ্ঠানটির ইমেজ সংকটের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি বার্তা দিয়েছি। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হবো। কেউ যদি নিয়মনীতি না মানেন তাহলে তাকে এনবিআর ছাড়তে হবে।’
গত ১৮ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে আবদুর রহমান খান বলেন, ‘এন্ড টু এন্ড অটোমেশন করতে হবে। এখন আমরা প্রাথমিক কিছু অটোমেশন করবো। তবে আমাদের মূল লক্ষ্য হলো যতদিন লাগুক না কেন, আমাদের ব্যাপক আকারে অটোমেশন করতে হবে। এটা ইফেকটিভ ও সাসটেইনেবল হতে হবে। কাস্টমস, আয়কর ও মূসক আইন নিয়ে তিনটি আলাদা টাস্কফোর্স করা হবে। রাজস্ব সংক্রান্ত তিনটি আইন আধুনিকায়নে তিনটি টাস্কফোর্স করা হবে। ব্যবসায়ী ও কর কর্মকর্তাদের মতামত নিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে।’
এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পলিসি তৈরি করতে হবে। আমরা যদি প্রতি দুই-পাঁচ বছর পর পলিসি পরিবর্তন করি তাহলে বিনিয়োগকারীর পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবো। কর্মকর্তাদের বলেছি, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য।’
এসএম/এমএইচআর/এমএমএআর/জিকেএস