জাল শিক্ষা সনদে দুই বিমা কোম্পানির সিইও পদে নিয়োগ চুক্তি
শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদ দিয়ে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দুটি জীবন বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে চুক্তি করেন মোহাম্মদ আবদুল মতিন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে সিইও’র অনুমোদন চেয়ে আবেদনও করেন। বিমা কোম্পানির শীর্ষ পদে নিয়োগ পেতে এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেন তিনি।
শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদ দিয়ে তিনি বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পান। কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে করা এ নিয়োগ চুক্তি অনুমোদনের জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছেও পাঠানো হয়। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের আগেই বেস্ট লাইফ ছেড়ে দিয়ে মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগের চুক্তি করেন আবদুল মতিন।
এছাড়া আবদুল মতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তার মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্নপদে কর্ম অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি সবশেষ কর্মস্থল প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে তাকে ছাড়পত্রও দেওয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে অবস্থিত সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে নেওয়া আবদুল মতিনের মাস্টার অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন- এমবিএর সনদটি জাল।
সনদ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, আবদুল মতিন ২০০৪ সালে ‘ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি হন ২০০৪ সালের আগস্টে সামার সেমিস্টারে। আর তার সনদ ইস্যু করা হয়েছে একই বছরের ২০ অক্টোবর।
আবদুল মতিনের সনদ জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের কন্ট্রোলার অব এক্সামিনেশনস ড. বিজয় শঙ্কর বড়ুয়া।
আরও পড়ুন
- রক্ত পানি করা টাকা চুষে খাচ্ছে বিমা কোম্পানি
- ব্যবসায় অর্ধেক লোকসান, দামে ‘পাগলা ঘোড়া’
- গ্রাহক হারাচ্ছে বিমা কোম্পানি, পেশা ছাড়ছেন এজেন্টরা
এ বিষয়ে বিজয় শঙ্কর বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল মতিনের সনদ যাচাই করা হয়েছে। যাচাইয়ে প্রমাণিত হয়েছে তার সনদ ফেক বা জাল। গত ২৭ জুন ২০২৪ তারিখে এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ই-মেইল করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আবদুল মতিনের সনদে উল্লেখিত স্টুডেন্ট’স আইডি নম্বর, প্রাপ্ত ডিগ্রি, অর্জিত সিজিপিএ, স্বাক্ষর, কোড নম্বর– কোনোটিই সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের কন্ট্রোলার অব এক্সামিনেশনস অফিসে সংরক্ষিত নথির সঙ্গে মেলেনি।’
আবদুল মতিনের সনদে উল্লেখিত স্টুডেন্ট’স আইডি নম্বর, প্রাপ্ত ডিগ্রি, অর্জিত সিজিপিএ, স্বাক্ষর, কোড নম্বর– কোনোটিই সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের কন্ট্রোলার অব এক্সামিনেশনস অফিসে সংরক্ষিত নথির সঙ্গে মেলেনি।-সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের কন্ট্রোলার অব এক্সামিনেশনস ড. বিজয় শঙ্কর বড়ুয়া
বিজয় শঙ্কর বড়ুয়া আরও বলেন, ‘আবদুল মতিনের সনদটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইস্যু করা হয়নি। তিনি কোথা থেকে এটি বানিয়েছেন, সেটি আমরা বলতে পারবো না। যেহেতু তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে, সেজন্য আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি।’
কেউ আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ জাল, জালিয়াতি করলে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নেন? এমন প্রশ্ন করা হলে বিজয় শঙ্কর বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা এ ধরনের তথ্য পেলে অনেক সময় আইনগত ব্যবস্থা নেই। এরই মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
জানা যায়, বেস্ট লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে আবদুল মতিনের নিয়োগ অনুমোদনের জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে আবেদন করা হয় ২০২৩ সালের ১৮ জুন। কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ মল্লিক ওই আবেদন করেন।
বেস্ট লাইফের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের চুক্তিপত্র সংশোধনসহ আরও কিছু তথ্য চেয়ে কোম্পানিটিকে চিঠি দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর পাঠানো ওই চিঠিতে মুখ্য নির্বাহীর বেতন-ভাতা পুনর্নির্ধারণও করে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে বেস্ট লাইফের মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ অনুমোদনের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই কোম্পানিটি ছেড়ে মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফে যোগ দেন আবদুল মতিন। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি তিনি মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগের চুক্তি করেন।
তবে সেখানেও স্থায়ী হতে পারেননি আবদুল মতিন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তার নিয়োগ অনুমোদনের আবেদন পাঠানোর আগেই কোম্পানিটি ছাড়তে হয়। শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদ ও বিজ্ঞাপন ব্যবসার অভিযোগ মাথায় নিয়ে আবদুল মতিন মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ থেকে বিদায় নেন বলে জানা যায়।
আবদুল মতিন এর আগে প্রাইম ইসলামী লাইফে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ডিএমডি পদটি প্রাইম ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্নপদ নয়। অন্য কোনো কোম্পানিতেও মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে কাজ করেননি আবদুল মতিন।
ফলে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালার শর্ত অনুসারে ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা’ হিসেবে বিমা কোম্পানিতে যোগদানের যোগ্যতা নেই আবদুল মতিনের। এছাড়াও সবশেষ কর্মস্থল প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে ছাড়পত্রও নিতে পারেননি তিনি। ২০২৩ সালের ৩ এপ্রিল থেকে প্রাইম ইসলামী লাইফের চাকরি ছাড়েন।
আবদুল মতিন প্রাইম ইসলামী লাইফ ছাড়াও ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। তবে মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ছাড়ার পর আর কোনো বিমা কোম্পানিতে যোগ দেননি।
এ বিষয়ে আবদুল মতিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে পদত্যাগ করেছি। বর্তমানে আমি কোনো কোম্পানিতে জয়েন করিনি।’
এ সময় জাল সনদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি মোবাইলে ‘কথা শোনা যাচ্ছে না’ উল্লেখ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর তার মোবাইল ফোনে আরও কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল ধরেননি।
এমএএস/এএসএ/এমএস