ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

চট্টগ্রামে বিপিসির প্রধান কার্যালয় ‘নামকাওয়াস্তে’

ইকবাল হোসেন | প্রকাশিত: ১১:০১ এএম, ২১ আগস্ট ২০২৪

• চেয়ারম্যান মাসে আসেন দু-একবার, থাকেন এক-দুদিন
• তিন পরিচালক মাসের প্রায় পুরোটা সময় থাকেন ঢাকায়

অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এগোতে পারছে না দেশের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অযাচিত হস্তক্ষেপে বিপিসির প্রায় সব প্রকল্পে ধীরগতি। এসব নিয়ে জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের করা ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বাণিজ্যিক রাজধানীর চট্টগ্রামে গুটিকয়েক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে থাকলেও ঢাকার লিয়াজোঁ অফিসকে ঘিরে চলে বিপিসির যাবতীয় কর্মকাণ্ড। চেয়ারম্যান প্রায় পুরোটা সময় অফিস করেন ঢাকায়। সঙ্গে থাকেন পরিচালকরাও।

অভিযোগ রয়েছে, বিপিসি চেয়ারম্যান মাসে দু-একবার চট্টগ্রামে আসেন। থাকেন এক কিংবা দুদিন। তিন পরিচালকই বেশিরভাগ সময় থাকেন ঢাকায়। অথচ চেয়ারম্যান, পরিচালকদের জন্য বিপিসির জয়পাহাড়ে কোটি টাকার বাংলোগুলোর কোনোটিতে থাকেন অপেক্ষাকৃত অধঃস্তন কর্মকর্তারা। বিপিসির সিনিয়র অফিসিয়ালরা ঢাকামুখী হওয়ার কারণে অনেক মিটিং ঢাকায় গিয়ে করতে হয় বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। এতে সরকারি রাজস্বের অপচয় হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আমি কয়েক বছর ঢাকায় ছিলাম। এর আগে মার্কেটিং স্যারের পিএ ছিলাম। এক সপ্তাহ ধরে অপারেশন স্যারের পিএ করা হয়েছে। আমি ২০২১ সাল থেকে ঢাকায় ছিলাম। ২০২৩ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামে ট্রান্সফার করা হয়। কিছুদিন আগে আবার ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় এসেছি।- অনুপম বড়ুয়ার পিএ বদরুননেছা

সূত্র জানায়, চেয়ারম্যানসহ বিপিসির সিনিয়র কর্মকর্তাদের ঢাকামুখিতার কারণে ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ‘বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হেড অফিস চট্টগ্রামে অবস্থান প্রসঙ্গে’ নির্দেশনা সম্বলিত একটি পত্র দেওয়া হয় চেয়ারম্যানকে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের ওই সময়ের উপ-সচিব সৈয়দা নওয়ারা জাহান স্বাক্ষরিত পত্রে ‘বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিপিসির হেড অফিস চট্টগ্রামে না থেকে প্রায়ই ঢাকা অবস্থান করছেন। উক্ত কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতির কারণে বিপিসির দাপ্তরিক কাজকর্ম সঠিক সময়ে সম্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতির ফলে উক্ত অফিসে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত/অফিসিয়াল কাজে ঢাকায় আসার প্রয়োজন হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ এবং বিপিসির কোনো মিটিং করার প্রয়োজন হলে তা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে মিটিংয়ের সময় নির্ধারণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। চেয়ারম্যান ও অন্য পরিচালকরা ঢাকামুখী হওয়ার কারণে বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিনিয়র কর্মকর্তারাও ঢাকামুখী হয়ে পড়ছেন। কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক সপ্তাহের অর্ধেক সময় ঢাকায় অফিস করেন। আবার কোম্পানির দাপ্তরিক অনেক মিটিংও ঢাকায় করতে হয়। বিশেষ করে মাসিক সাধারণ সভা ও বোর্ডসভার বেশিরভাগই ঢাকায় করতে হয় বিপণন কোম্পানিগুলোকে। সবশেষ এসএওসিএলের ৫৫তম বার্ষিক সাধারণ সভাও হয়েছে ঢাকার কারওয়ান বাজারের লিয়াজোঁ অফিসে।

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিপিসিতে পাঁচজন সরকারি আমলা পদায়িত রয়েছেন। চেয়ারম্যান পদে একজন সচিব, তিন পরিচালক পদে তিনজন যুগ্ম সচিব এবং বিপিসির সচিব পদে একজন উপসচিব। একমাত্র বিপিসির সচিবই বেশিরভাগ সময় প্রধান কার্যালয়ে থাকেন। তিনি ঢাকায় অবস্থান করা চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের আজ্ঞা পালনে দিন পার করেন। কারণ চেয়ারম্যান এবং পরিচালকদের কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলেই তারা ঢাকা থেকে ফোনে সচিবের দ্বারস্থ হন। আর সচিবের দৌড়ঝাঁপে হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা মেইলে ঢাকায় চলে যায় তাদের চাওয়া তথ্য।

চট্টগ্রামে বিপিসির প্রধান কার্যালয় ‘নামকাওয়াস্তে’

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরেও চেয়ারম্যান, পরিচালকদের ঢাকামুখী হওয়ার বেপরোয়া চিত্র পাওয়া যায় তিন পরিচালকের পিএ পদায়ন নিয়ে। মো. আল মামুন, মো. দিদারুল আলম এবং বেগম বদরুননেছা। তিনজনের মধ্যে আল মামুন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পরিচালক (অপা. ও পরি.) অনুপম বড়ুয়য়ার পিএ, দিদারুল আলম পরিচালক (অর্থ) মো. আবদুল মতিনের পিএ এবং বদরুন্নেছা আরেক পরিচালক (বিপণন) কবীর মাহমুদের পিএ। তাদের মধ্যে আল মামুন এবং বদরুননেছাকে কোনো অফিস আদেশ ছাড়াই প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ঢাকায় লিয়াজোঁ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সবশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্ত হন দিদারুল আলম।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১২ ফেব্রুয়ারি পরিচালক (অর্থ) হিসেবে বিপিসিতে যোগ দেন সরকারের যুগ্ম সচিব মো. আবদুল মতিন। দুদিন পর তিনি চট্টগ্রাম প্রধান কার্যালয়ে আসেন। আর পরের দিনই পিএ দিদারুল আলমকে অলিখিত আদেশে স্থায়ীভাবে ঢাকা লিয়াজোঁ অফিসে নিয়ে যান।

এখন অফিসিয়াল অনেক মিটিং ভার্চুয়ালি হয়। অফিস নথির কাজও হয় ডি-নথির মাধ্যমে। যে কারণে একজন কর্মকর্তা দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই অবস্থান করুন না কেন ডি-নথির মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায়। তারপরেও আমরা বিপিসির অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সভাগুলো সরাসরি করি।- বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান

বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য চাইলে এক পর্যায়ে মে মাসে নড়েচড়ে বসে বিপিসি প্রশাসন। গত ২৪ মে বিপিসির সচিব মুহম্মদ আশরাফ হোসেন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তিনজনকে প্রধান কার্যালয় থেকে বিপিসির ঢাকার লিয়াজোঁ অফিসে বদলি করা হয়। ওইদিন তাদের কর্মস্থল দেখানো হয় চট্টগ্রাম সল্টগোলার প্রধান কার্যালয়ে।

জানতে চাইলে বিপিসির সচিব মুহম্মদ আশরাফ হোসেন কোনো বক্তব্য দিতে সম্মত হননি। এরপর কোরবানির ঈদের আগে ঢাকায় অবস্থান করা পরিচালক অপারেশন এবং পরিচালক বিপণনের দুই পিএকে অদলবদল করে পদায়ন করা হয়। সেটাও কোনো অফিস আদেশ ছাড়াই।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে পরিচালক (বিপণন) কবীর মাহমুদের পিএ মো. আল মামুনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি দুই বছর ধরে ঢাকা অফিসে কর্মরত। তবে ঢাকা অফিসে পদায়নের বিষয়ে কোনো অফিস আদেশ ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।’

পরিচালক (অপা. ও পরি.) অনুপম বড়ুয়ার বর্তমান পিএ বদরুননেছার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কয়েক বছর ঢাকায় ছিলাম। এর আগে মার্কেটিং স্যারের পিএ ছিলাম। এক সপ্তাহ ধরে অপারেশন স্যারের পিএ করা হয়েছে। আমি ২০২১ সাল থেকে ঢাকায় ছিলাম। ২০২৩ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামে ট্রান্সফার করা হয়। কিছুদিন আগে আবার ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় এসেছি।’

পরিচালক (অর্থ) মো. আবদুল মতিনের পিএ দিদারুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি অফিস অর্ডার হওয়ার পরেই ঢাকায় এসেছি।’ তবে ঢাকায় অবস্থান কতদিন হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অফিস অর্ডার দেখে বলতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ এপ্রিল বিপিসির চেয়ারম্যান হিসেবে ঢাকার লিয়াজোঁ অফিসে যোগ দেন সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া মো. আমিন উল আহসান। বিগত আড়াই মাসে পাঁচবার চট্টগ্রামে এসেছেন। ২৭ জুন তিনি একদিনের জন্য চট্টগ্রাম প্রধান কার্যালয়ে আসেন। সবশেষ ২৬ জুলাই থেকে চারদিনের সফরে তিনি চট্টগ্রামে অবস্থান করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিপিসির চেয়ারম্যান ঢাকায় থাকার কারণে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকতে হয়। প্রত্যেকটি বিপণন কোম্পানির বোর্ড সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে কোম্পানিগুলোর ব্যয়ও বেড়েছে। কোম্পানির ব্যয় বেড়ে যাওয়ার মানেই সরকার এবং পাবলিক শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।’

জানা যায়, ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত পেট্রোবাংলার একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল বিপিসি। ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি আলাদা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিপিসি গঠিত হয়। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয় এবং প্রধান ডিপো চট্টগ্রামে হওয়ায় ও সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ নীতির কারণে ১৯৮৯ সালে বিপিসির প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়। তখনকার বিপিসির চেয়ারম্যান ফজলুল হক চট্টগ্রামে অবস্থান করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী চেয়ারম্যান সরকারের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেনও মাসের বেশিরভাগ সময় চট্টগ্রামেই অফিস করতেন। অপ্রয়োজনে তিনি ঢাকায় যেতেন না।

ধারাবাহিকভাবে বিপিসির অনেক চেয়ারম্যান জয়পাহাড়ের ১ নম্বর বাংলোতে থাকতেন। চেয়ারম্যানের ওই বাংলোকে বর্তমানে ভিআইপি রেস্ট হাউজ বানিয়েছে বিপিসি। বর্তমানে চেয়ারম্যানের পাশাপাশি বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) অনুপম বড়ুয়া, পরিচালক (অর্থ) মো. আবদুল মতিন এবং পরিচালক (বিপণন) কবীর মাহমুদও থাকেন ঢাকায়। তারা শুধু মিটিং করার জন্যই চট্টগ্রামে আসেন। তবে পরিচালক (অর্থ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মো. শহীদুল আলম সবশেষ পরিচালক হিসেবে চট্টগ্রামে প্রধান কার্যালয়ে নিয়মিত অফিস করতেন।

এ বিষয়ে ২৯ জুলাই বিকেলে বিপিসির প্রধান কার্যালয়ে কথা হয় বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন অফিসিয়াল অনেক মিটিং ভার্চুয়ালি হয়। অফিস নথির কাজও হয় ডি-নথির মাধ্যমে। যে কারণে একজন কর্মকর্তা দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই অবস্থান করুন না কেন ডি-নথির মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায়। তারপরেও আমরা বিপিসির অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সভাগুলো সরাসরি করি।’

কর্মকর্তাদের ঢাকামুখিতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সবগুলো মন্ত্রণালয়ের দপ্তর ঢাকায়। বিপিসির প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের মিটিং ঢাকায় হয়। আবার জ্বালানি সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণাল সভাও হয় ঢাকায়। যে কারণে কোম্পানির এমডিসহ আমাদের পরিচালকদের বড় একটি অংশের সময় কাটাতে হয় ঢাকায়। আমি নিজেও মাসে দু-একবার চট্টগ্রামে অফিস করি।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এএসএম

বিজ্ঞাপন