ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

এসএওসিএলে দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ নেই বিপিসির

ইকবাল হোসেন | চট্টগ্রাম | প্রকাশিত: ১০:৫১ এএম, ১৮ আগস্ট ২০২৪

অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এগোতে পারছে না দেশের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অযাচিত হস্তক্ষেপে বিপিসির প্রায় সব প্রকল্পে ধীরগতি। এসব নিয়ে জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের করা ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে পঞ্চম পর্ব।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল)। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। বাণিজ্যিক অডিটে দুর্নীতি-অনিয়মসহ আপত্তি ওঠা ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার বছরেও ব্যবস্থা নেয়নি অভিভাবক প্রতিষ্ঠান।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি দুদক হটলাইনে আসা এক অভিযোগের সূত্র ধরে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় অভিযান চালিয়ে এসএওসিএলের পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদ ও তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে ৫৭ কোটি টাকা অবৈধভাবে স্থানান্তরের প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই ঘটনার পর ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এসএওসিএলের ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়-ব্যয় ও অডিটসহ সার্বিক আর্থিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার জন্য সরকারের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিপিসি।

পরবর্তীসময়ে বিপিসির তদন্ত কমিটি এসএওসিএলের অসহযোগিতার অভিযোগ এনে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের শুধু নমুনাভিত্তিক কিছু আর্থিক কার্যক্রমের অনুসন্ধান করে প্রায় তিনশ কোটি টাকা অনিয়মের সত্যতা পায় কমিটি। পরে তদন্ত প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠায় বিপিসি। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. শাহেদ।

এদিকে বিপিসির তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ২০২১ সালের ৯ মার্চ প্রায় ৮১ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। আগেই মারা যাওয়ায় মহাব্যবস্থাপক শাহেদকে মামলায় আসামি করা সম্ভব হয়নি।

উচ্চ আদালত ও অডিট অধিদপ্তরের যেসব আপত্তি ছিল, আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারি অডিট আপত্তিতে ওই ১৪ কর্মকর্তার বিষয় থাকলে, সে বিষয়ে আমি অবগত হয়ে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবো।- বিপিসি ও এসএওসিএলের চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান

এসএসওসিএলের ২০১৩-২০১৪ থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত এবং ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের অংশ বিশেষের ওপর নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে সরকারি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদপ্তর। ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষা কাজ শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেন নিরীক্ষা দলের নেতা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স অফিসার নারায়ণ চন্দ্র সাহা। বাণিজ্যিক ওই অডিটে কোনো প্রকার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ইচ্ছামতো সরাসরি আবেদনের মাধ্যমে ১৪ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার গুরুতর অনিয়ম উত্থাপন করা হয়।

অভিযোগ ওঠা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন- সিনিয়র অফিসার (মেনটেন্যান্স) মো. শহিদুল ইসলাম, জুনিয়র অফিসার (টেকনিক্যাল) দুর্জয় দে, অফিসার (হিসাব) মো. ফখরুল ইসলাম, টেকনিক্যাল অফিসার মো. আনোয়ার জাহিদ, সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল) প্রলয় চক্রবর্তী, জুনিয়র সেলস অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (প্রকৌ ও অপা.) মো. মোকাররম হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. মাহমুদুল হক, জুনিয়র অফিসার (অপারেশন) মো. সামীম সহিদ, টেকনিক্যাল অফিসার মো. আনিসুর রহমান, অফিসার (এইচআর) আবদুল্লাহ আল মামুন, অফিসার (সেলস) মীর হোসেন, ম্যানেজার (প্রোডা ও অপা.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান ও অফিস সহকারী মো. আশরাফ উদ্দিন।

আরও পড়ুন

অনুমোদনহীনভাবে ৫০ কোটি টাকার এফডিআর ভাঙিয়ে ৯৪ লাখ টাকা তছরুপ, বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই এসএসসি পাস না করা লোককে সিনিয়র অফিসার হিসেবে নিয়োগ, এসএওসিএলের টাকায় আমদানি করা দুটি লিফট সাবেক জিএমের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে লাগিয়ে দেওয়া, মেশিন আমদানির নামে বিদেশ সফর, অনুমোদনহীন গাড়ি ব্যবহার করে অর্থ অপচয়সহ নানান অভিযোগ রয়েছে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া, ৩০ বছরের অধিক বয়সীদের অফিসার হিসেবে নিয়োগ, চাকরিচ্যুত হওয়ার কয়েক বছর পরে নিয়মবহির্ভূতভাবে পুনরায় নিয়োগের অভিযোগও রয়েছে অডিট আপত্তিতে।

কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ হওয়া ১৪ জনকে কোনো প্রকার বিজ্ঞপ্তি ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়াই স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাদের কয়েকজনের মাসিক বেতন-ভাতা এখন লাখ টাকার ওপর। এর মধ্যে একজন সিনিয়র অফিসার (মেনটেন্যান্স) শহিদুল ইসলাম। তার ব্যক্তিভিত্তিক অডিট আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে নিয়োগ এবং অস্থায়ী নিয়োগের শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে শহিদুলের নিয়োগে।

এসএওসিএল এখন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরেছে। অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সে অনুযায়ী পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।- এসএওসিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনি লাল দাশ

তালিকায় ২ নম্বরে রয়েছেন জুনিয়র অফিসার (টেকনিক্যাল)। তাকে আবেদনের তারিখের আগেই নিয়োগ দেওয়া এবং একাধিকবার ক্যাজুয়াল নিয়োগ দেওয়া হয়। তালিকার ৩ নম্বরে থাকা অফিসার (হিসাব) ফকরুল ইসলাম ভুইয়াকে স্থানীয় নিয়োগে ৮৯ দিনের শর্ত ভঙ্গ, অভিজ্ঞতা ছাড়া প্রজেক্টে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৪ নম্বরে থাকা টেকনিক্যাল অফিসার আনোয়ার জাহিদকে শুধু আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি দেওয়া হয়। কমিটির সুপারিশ ছাড়া শুধু আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যানেজারের সুপারিশে পদোন্নতি দেওয়া হয় তাকে। তাছাড়া স্থায়ী নিয়োগের সময় মেডিকেল রিপোর্টে কোলেস্টরেল, এলডিএল, এইচডিএল ও টিজি রেফারেন্স ভ্যালু অপেক্ষা কম/বেশি পাওয়ার কথা অডিট আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়।

একইভাবে তালিকায় ৫ নম্বরে থাকা সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল) প্রলয় চক্রবর্তীকেও আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি দেওয়া হয়। তাকে অফিসের বাইরে কনসালটেন্সি করার অনুমতি প্রদান, আগে যে অফিসে চাকরি করতেন, সে প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানির নির্মাণকাজ প্রদানে ভূমিকা রেখেছেন এবং স্থায়ী নিয়োগের সময় মেডিকেল রিপোর্টে কোলেস্টরেল, এলডিএল, এইচডিএল ও টিজি রেফারেন্স ভ্যালু অপেক্ষা কম/বেশি পাওয়ার কথা অডিট আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়।

এভাবে তালিকার ১৪ নম্বরে থাকা ব্যক্তি পর্যন্ত সবাইকে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ, পদোন্নতি ও সুবিধা দেওয়া হয় বলে অডিট আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়।

তিন বছর পার হলেও প্রতিবেদন দেয়নি কমিটি
২০২১ সালের ১২ এপ্রিল বিপিসি ও এসএওসিএলের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. আবু বকর ছিদ্দীকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এসএওসিএলের ৪০৬তম পর্ষদ সভায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদপ্তরের অডিট আপত্তি ওঠা ১৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য চার সদস্যের কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ২৬ এপ্রিল চার সদস্যের কমিটি গঠন করে অফিস আদেশ জারি করে এসএওসিএল।

কমিটির এসএওসিএলের পরিচালক ও ম্যাক প্রেসিডেন্ট মিশু মিনহাজকে সভাপতি, উপ-মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদ, বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ফেরদৌসী মাসুম হিমেলকে সদস্য এবং এসএওসিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (হিসাব) মো. কামরুল হুদাকে সদস্য সচিব করা হয়। পরবর্তী ২৪ জুনের মধ্যে চেয়ারম্যান বরাবর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয় ওই পত্রে। কিন্তু অদ্যাবধি ওই কমিটি প্রতিবেদন দেয়নি।

ওই কমিটি এখনো বাতিল বা পুনর্গঠন হয়নি। এ ব্যাপারে কথা হলে কমিটির সদস্য সচিব কামরুল হুদা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওই কমিটি গঠন হলেও কোনো কার্যক্রম হয়নি। কোনো প্রতিবেদনও দেওয়া হয়নি। এখন কমিটিও ওই অবস্থায়ই আছে।’

বিপিসি পরিচালক (অর্থ ও বিপণন) থেকে বদলির আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এসএওসিএলে আমরা পরিচালনায় থাকলেও সবকিছুই প্রধান নির্বাহী দেখভাল করেন। আমাদের কাছে কোনো রিপোর্ট উপস্থাপন করা হলে কিংবা পর্ষদ সভায় কোনো বিষয় উপস্থাপন হলে আমরা সেগুলো দেখতাম। তারপরেও এসএওসিএলের অনিয়মগুলো অনেক পুরোনো। প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম দূর করার জন্য অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। সবগুলো সঠিকভাবে কার্যকর করা হয়েছে কি না সেটি আমার জানা নেই।’

এ বিষয়ে গত ২৯ জুলাই বিকেলে বিপিসির প্রধান কার্যালয়ে কথা হয় বিপিসি ও এসএওসিএলের চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বিপিসিতে যোগদান করেছি নতুন। এসএওসিএলের বিষয়েও খোঁজখবর নিচ্ছি। উচ্চ আদালত ও অডিট অধিদপ্তরের যেসব আপত্তি ছিল, আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারি অডিট আপত্তিতে ওই ১৪ কর্মকর্তা বিষয় থাকলে, সে বিষয়ে আমি অবগত হয় তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবো।’

এসএওসিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনি লাল দাশ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এসএওসিএল এখন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরেছে। অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সে অনুযায়ী পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএস