ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

দলীয়করণে ব্যবসায়ী সংগঠনে অস্থিরতা, প্রয়োজন সংস্কার

সাইফুল হক মিঠু | প্রকাশিত: ০১:১৪ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২৪

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবসান ঘটেছে টানা ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনের। শেখ হাসিনার আগে ও পরে দেশত্যাগ করেছেন বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের আওয়ামী লীগপন্থি নেতারা। কেউ কেউ দেশে থাকলেও প্রকাশ্যে আসছেন না। তাদের অনুপস্থিতিতে স্থবিরতা চলছে ব্যবসায়ী সংগঠনে। কোথাও কোথাও নতুন কমিটি গঠনের দাবিও উঠেছে।

স্থবিরতা চলছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতিতে (বিজিএমইএ)। সংগঠনটির নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট ফোরামের নেতাকর্মীরা গত ৭ আগস্ট উত্তরায় বিজিএমইএর কার্যালয়ে গিয়ে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের ওপর অনাস্থা জানিয়ে স্মারকলিপি দেন। তারা ওই দিনই কমিটি ভেঙে দিতে পর্ষদকে চাপ দেন। এ বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনায় বেশ হট্টগোলও হয়।

বিজিএমইএ সভাপতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগ

ফোরামের স্মারকলিপিতে বলা হয়, বর্তমান বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান কচি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। গত ৪ আগস্ট মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে ছাত্র-জনতার ওপর কচি গুলিবর্ষণ করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দমন-পীড়ন ও হত্যায় উত্তরা ও মিরপুরে কচির নেতৃত্বে তার ক্যাডার বাহিনী মূল ভূমিকা পালন করে। এটি সব গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

সদস্যরা অভিযোগ করেন, ২০২৪ সালের ৯ মার্চ বিজিএমইএ পর্ষদ নির্বাচনে এস এম মান্নান কচি ও তার দল ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সংগঠনটির ক্ষমতা দখল করেন। এ কাজে সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী, শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামকে নিজ বাহিনীসহ সরাসরি অংশ নিতে দেখা যায়। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও এ দায় এড়াতে পারেন না।

আরও পড়ুন-

স্মারকলিপিতে বলা হয়, ছাত্র আন্দোলনে কয়েকশ ছাত্র-জনতা নিহত হওয়ার পরও বর্তমান বোর্ড ও সভাপতি কোনো শোকবার্তা দেননি। ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন ও গণজোয়ারে বিজিএমইএ সভাপতি ও তার বোর্ড সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ভূমিকা পালন করায় তারা দায়িত্ব পালনের নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন।

দলীয়করণে ব্যবসায়ী সংগঠনে অস্থিরতা, প্রয়োজন সংস্কার

বিজিএমইএ সভাপতি ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি গত ৪ আগস্ট মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে ছাত্র আন্দোলন মোকাবিলা নিয়ে বক্তব্য দেন। ছবি: সংগৃহীত

সংকটে কারখানা খোলা নিয়ে সংগঠনটির কোনো সঠিক নির্দেশনা দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে বলা হয়, গত কয়েক সপ্তাহে বিজিএমই ব্যবসা পরিচালনায় কার্যকর কোনো নির্দেশনা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। গত ৪ আগস্ট সকাল থেকে ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে মিরপুর-১০ গোলচত্বর দখলে নেয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সংসদ সদস্য নিখিল এবং বিজিএমইএ সভাপতি কচির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। দুপুর ১টার দিকে কচি তার বক্তব্যে বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে দাঁড়াবে তাকে শেষ করে দিতে হবে।’

ফোরামের নেতাকর্মীরা গত সোমবার হোটেল সোনারগাঁওয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিজিএমইএর সভাপতি ও পরিচালকদের পদত্যাগের দাবি জানান। একই সঙ্গে দলীয় প্রভাবমুক্ত অন্তর্বর্তী পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানান।

লিখিত বক্তব্যে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও অনন্ত কোম্পানিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হক খান বলেন, গত ৯ মার্চের নির্বাচনে এস এম মান্নান তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে নজিরবিহীন কারচুপি ও ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে পর্ষদে আসেন। এসব অবৈধ কাজে বিজিএমইএর সাবেক তিনজন সভাপতি নিজেদের লোকজন নিয়ে সরাসরি অংশ নেন। এসব ঘটনায় সাধারণ সদস্যদের মনে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়।

দলীয়করণে ব্যবসায়ী সংগঠনে অস্থিরতা, প্রয়োজন সংস্কার

সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে একটি ভিডিও দেখানো হয়।

বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান কচি বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিটিএমএ থেকে খোকনের পদত্যাগ

গত ১১ আগস্ট ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন ম্যাকসন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী খোকন। সংস্থাটির সাবেক সহ-সভাপতি ও আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেল সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন।

খোকন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, ছিলেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি ২০২৩-২০২৪ ও ২০২৪-২০২৫ মেয়াদের জন্য বিটিএমএর সভাপতি হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

অফিস করছেন না এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অফিস করছেন না ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম। চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়ক সদস্য। অবস্থান জানতে তার নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি উত্তর দেননি।

আরও পড়ুন-

চিকিৎসা, আমদানি-রপ্তানি, মেটালসহ একাধিক ব্যবসায় শত কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে মাহবুবুল আলমের। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা চারবার হয়েছেন সিআইপি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এফবিসিসিআইয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, গত ৫ আগস্টের পর সভাপতি মতিঝিলের অফিসে আসেননি। তবে তিনি দেশেই আছেন।

ই-ক্যাব থেকে সরে দাঁড়ালেন শমী কায়সার

দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার ৫ আগস্টের পর অফিস করেননি। আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপ-কমিটির এই সদস্য গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) সংগঠনের প্যাডে ই-ক্যাবের নির্বাহী পরিষদ বরাবর লেখা এক চিঠির মাধ্যমে তিনি পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রটি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করার অনুরোধও জানিয়েছেন তিনি।

২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো ই–ক্যাবের সভাপতির দায়িত্ব পান শমী কায়সার। ২০২২ সালে সংগঠনটির প্রথম সরাসরি নির্বাচনে শমীর নেতৃত্বাধীন প্যানেল সংখ্যাগরিষ্ঠ পায় এবং তিনি ২০২২-২৪ মেয়াদে সভাপতি নির্বাচিত হন। ই-ক্যাবের ২০২৪-২৬ মেয়াদের নির্বাহী কমিটির নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল গত ২৭ জুলাই। এতেও শমী কায়সারের নেতৃত্বে একটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল। দেশের পরিস্থিতির কারণে এই নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।

সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ই-ক্যাবের ব্যানারে আওয়ামী মদতপুষ্ট ই-ক্যাবের দুর্নীতিবাজ নির্বাহী কমিটির প্রতি পূর্ণ অনাস্থা জানিয়ে তাদের পদত্যাগ, চলমান নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্থগিত করাসহ ১৫ দফা দাবি জানান সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে ই-ক্যাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া, প্রশাসকের মাধ্যমে অডিটের ব্যবস্থা করা, ভোটার তালিকা থেকে ভুয়া ভোটার বাদ দিয়ে শুধু প্রকৃত ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি।

তারা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ই-কমার্স উদ্যোক্তা ও ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল বিপুল জনগোষ্ঠীর অন্ন সংস্থানের কথা চিন্তা না করেই সরকারের ইন্টারনেট বন্ধ ও গতি কমিয়ে দেওয়ায় তারা সবাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকেই চাকরি হারান। আবার অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে প্রায় পথে বসার উপক্রম হয়। কিন্তু এত কঠিন সংকটময় মুহূর্তে ই-ক্যাবের মতো প্রাসঙ্গিক জাতীয় প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও তারা সদস্যদের কথা বলিষ্ঠভাবে বলেনি।

দলীয়করণের কারণে অচলায়তন

দলীয়করণের কারণে সংগঠনগুলোয় এমন অচলায়তন সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, বিগত ১৬ বছরে সংগঠনগুলোয় নির্লজ্জ দলীয়করণ হয়েছে। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই সংগঠনের শীর্ষ পদে গেছেন। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ফাহিম মাশরুর বলেন, এখন অনেক সংগঠন পুনর্গঠন বা নির্বাচনের কথাবার্তা হচ্ছে। এটা হওয়া উচিত। সংগঠনগুলোয় যোগ্য নেতৃত্ব আসা উচিত।

আরও পড়ুন-

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সংগঠনের শীর্ষ পদ দখল করলে ওই সংগঠন ও সংগঠন সংশ্লিষ্ট ব্যবসার ক্ষতি হয়। বিএনপিপন্থি কেউ হয়তো বা যোগ্য, তাকে যদি আমরা নির্বাচিত করি তাকে কি আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহণ করবে? ব্যবসায়ীদের যে নীতিসহায়তা প্রয়োজন সেগুলো কি তিনি আদায় করতে পারবেন? এসব কারণে যাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ভালো তাদের আমরা সংগঠনে নিয়ে আসি। কিন্তু তার মধ্যে কেউ কেউ আছে বেশি বাড়াবাড়ি করেন।

রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘অতি উৎসাহী লোকজন রাজনীতির মধ্যে আছে, ব্যবসায়ীদের মধ্যেও আছে। এই অতি উৎসাহীরা ব্যবসায়ীদের ডিস্টার্ব করে। তারপরও দুদিকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করে আমাদের চলতে হয়।’

ডিসিসিআই কিংবা মেট্রোপলিটন চেম্বারের কেউ তো দেশত্যাগ করেনি জানিয়ে অন্য সংগঠনকে এই দুই সংগঠন থেকে শিক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোরও সংস্কার দরকার

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ অন্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোরও সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ও ফেরদৌস বায়োটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেরদৌসী বেগম। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা জানতে চাইলে ৭ আগস্ট জাগো নিউজকে একথা জানান তিনি।

ফেরদৌসী বেগম বলেন, এফবিসিসিআইকে ঢেলে সাজানো দরকার। এত বছরে দেখলাম, এগুলোতে কোনো গণতন্ত্র নেই। এখানেও তাঁবেদার গোষ্ঠী চলে। অন্য ছোট ব্যবসায়ী সংগঠনও এমন।

এসএম/এমএমএআর/এএসএম