ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

৪৭ বছর ধরে ‘পরের ঘরে’ বিপিসি

ইকবাল হোসেন | প্রকাশিত: ০৮:২৬ এএম, ১৩ আগস্ট ২০২৪

• প্রধান কার্যালয় নির্মাণে একের পর এক জটিলতা
• সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ডিও লেটারে ভেস্তে যায় জয়পাহাড় প্রকল্প

অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এগোতে পারছে না দেশের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অযাচিত হস্তক্ষেপে বিপিসির প্রায় সব প্রকল্পে ধীরগতি। এসব নিয়ে জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের করা ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথমটি।

প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছর পার করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। দেশে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি খাতের আমদানি ও বিপণন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির এখনো নেই নিজস্ব কোনো প্রধান কার্যালয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলছে পরের ঘর ভাড়া নিয়ে। সবশেষ প্রধান কার্যালয় নির্মাণের পরিকল্পনাটিও ভেস্তে যায় সাবেক ভূমিমন্ত্রীর এক ডিও লেটারে।

বিপিসির প্রতিষ্ঠা

জানা যায়, ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত পেট্রোবাংলার একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ছিল বিপিসি। ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি আলাদা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিপিসি গঠিত হয়। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয় ও প্রধান ডিপো চট্টগ্রামে হওয়ায় এবং সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ নীতির কারণে ১৯৮৯ সালে বিপিসির প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়। শুরুতে নগরীর আগ্রাবাদের হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশনের বিল্ডিংয়ে প্রধান কার্যালয়ের কার্যক্রম চালাতো বিপিসি। এখন সল্টগোলা বন্দর ভবনের বিপরীতে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলা ও চতুর্থ তলার একাংশ ভাড়া নিয়ে চলছে কার্যক্রম।

বিপিসির প্রধান কার্যালয় নির্মাণ প্রকল্প

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে জামাল খান সংলগ্ন জয়পাহাড়ে প্রধান কার্যালয় নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বিপিসি। প্রতিষ্ঠানটির চাহিদা মোতাবেক ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রকল্পের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দও দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা হয়। ওই প্রকল্পে জয়পাহাড়ে ২০ তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

৪৭ বছর ধরে ‘পরের ঘরে’ বিপিসি

প্রকল্পে ২০১৯ সালে কনসালট্যান্ট নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিপিসি। ধারাবাহিক অংশ হিসেবে দুটি প্রতিষ্ঠান কনসেপচ্যুয়াল ডিজাইনও জমা দেয়। কিন্তু পরবর্তীসময়ে প্রস্তাবনা দুটি মূল্যায়ন পর্যায়ে মন্ত্রণালয়ের বাধার মুখে শুধু প্রধান কার্যালয় নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বিপিসি। এরপর মন্ত্রণালয়ের সুপারিশেই জয়পাহাড়কে সমন্বিততভাবে একটি মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়।

পরে জয়পাহাড় ঘিরে সমন্বিত স্থাপনা নির্মাণের সুন্দর ডিজাইন উপস্থাপনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বিপিসি। এরপর দেশসেরা নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রকল্পের ধারণাগত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। তিনি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘ভিত্তি’র প্রধান।

বিপিসি সূত্র জানায়, জয়পাহাড়ে বিপিসির মালিকানাধীন ৩০ একর জায়গা রয়েছে। পুরো এলাকাটিকেই নান্দনিক রূপে সাজানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয় তখন। ভিত্তির স্থপতিদের উপস্থাপিত ডিজাইনটি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ অনুমোদন করে। ওই ডিজাইনে প্রধান কার্যালয়ের ভবন বাদেও স্টাফ কোয়ার্টার, খেলার মাঠ, ঝুলন্ত সেতু, টেরাকোটাসহ দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা রাখা হয়। পুরো পরিকল্পনাটা হয় পাহাড় ও বনের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখেই।

২০২০ সালের শেষের দিকে বিপিসির ওই সময়ের পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহেদী হাসান প্রতিবেদককে জানান, জয়পাহাড়ে প্রধান কার্যালয় নির্মাণের বিষয়ে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ অনুমোদন দিয়েছে। গৃহীত হয়েছে ভিত্তি উপস্থাপিত ডিজাইনও। ডিজাইন উপস্থাপনের জন্য তাদের পাঁচ লাখ টাকা সম্মানি দেওয়া হয়েছে। ভিত্তিকে প্রকল্পের কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী ৫০ বছর সামনে রেখে জনবলের জন্য প্রয়োজনীয় অফিস বানাতে প্রস্তাবনা তৈরির কথা জানান স্থপতি ইকবাল হাবিব।

৪৭ বছর ধরে ‘পরের ঘরে’ বিপিসি

ভূমিমন্ত্রীর ডিও লেটারে ভেস্তে যায় প্রকল্প

তবে ২০২১ সালের শুরুতে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর এক ডিও লেটারে থেমে যায় জয়পাহাড়ে বিপিসির প্রধান কার্যালয় নির্মাণের সব আয়োজন। ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী সদ্য বিদায়ী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে ডিও লেটার দিয়ে জয়পাহাড়ে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ না করার অনুরোধ করেন।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওই পত্রে (পত্রসূত্র ৩১.০০.০০০০.০০১.০১.০০১.২১-৯১) উল্লেখ করা হয়, ‘চট্টগ্রাম শহরের সার্সন রোড সংলগ্ন জয়পাহাড় এস্টেট একটি ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রাচীন আবাসিক এলাকা। শতবর্ষের পুরোনো বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ অনিন্দ্য সুন্দর ছায়াঘেরা মনোরম এ পাহাড় নানা প্রজাতির গাছপালা ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর।

এছাড়া সিএস, আরএস ও বিএস রেকর্ড এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জয়পাহাড় মৌজার জমিকে আবাসিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ কারণে ব্রিটিশ আমল থেকে অদ্যাবধি এ পাহাড়ে কোনো বাণিজ্যিক স্থাপনা করা হয়নি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলাম, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এ পাহাড়ে একটি পাঁচতলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করবে। এরকম কোনো স্থাপনা এখানে নির্মাণ করা হলে তা অনেক শতবর্ষী ও বিরল প্রজাতির গাছ, সমৃদ্ধ পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করবে।’

তাছাড়া এই এস্টেট একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী আবাসিক এলাকা হিসেবে সুপরিচিত। তাই এখানে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা সমীচীন হবে না। এমতাবস্থায়, স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সুরক্ষা এবং জনস্বার্থে ঐতিহ্যবাহী জয়পাহাড় আবাসিক এলাকায় বিপিসির প্রস্তাবিত বাণিজ্যিক ভবণ নির্মাণ না করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি।’

৪৭ বছর ধরে ‘পরের ঘরে’ বিপিসি

২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটারটি ১৮ নম্বর ডায়েরি হিসেবে এন্ট্রি হয়। ওইদিনই নসরুল হামিদ সিনিয়র সচিবকে (জ্বালানি) মার্ক করে পত্রটিতে লেখেন ‘বিষয়টি জরুরি, ব্যবস্থা নিন।’ এরপরই ভেস্তে যায় বিপিসির জয়পাহাড়ে প্রধান কার্যালয় নির্মাণ প্রকল্প।

সরেজমিনে যা পাওয়া গেলো

সরেজমিনে দেখা যায়, বিপিসির জয়পাহাড়লাগোয়া বিপরীত পাশের পাহাড়ে সার্সন রোডেই রয়েছে ভূমি প্রতিমন্ত্রীর নিজস্ব বাসভবন। জয়পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক স্থাপনা। রয়েছে ১৫ তলার বেশি উচ্চতার ভবনও। রয়েছে চট্টগ্রামের শীর্ষ এক ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের অফিস।

সাড়ে ২৫ কোটি টাকায় বিপিসিকে নতুন জমি বরাদ্দ

জয়পাহাড় প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার পর অনেকটা তৎকালীন ভূমিমন্ত্রীর সহযোগিতায় বাকলিয়া মৌজায় ১১৯ শতক নাল শ্রেণির খাসজমি বিপিসিকে বরাদ্দ দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে ২০২২ সালের ১২ মে বরাদ্দ জমি বিপিসিকে সেলামিমূল্যে দিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। তারই ধারাবাহিকতায় পরের ২৯ মে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বরাদ্দ জমির অনুকূলে সেলামিমূল্য হিসেবে ২৫ কোটি ৩৯ লাখ ৫২ হাজার ৩০৭ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বিপিসি চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়।

২০২২ সালের ৭ জুন সরকারি কোষাগারে ওই টাকা জমা দেয় বিপিসি। পরবর্তীসময়ে বরাদ্দ জায়গা বিপিসিকে দেয় জেলা প্রশাসন। ৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী বিপিসির প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন। তবে বিগত দেড় বছরে তেমন অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) অনুপম বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিপিসির প্রধান কার্যালয় নির্মাণে এরই মধ্যে বাকলিয়ায় জমি পাওয়া গেছে। ভিত্তিপ্রস্তর হয়েছে। প্রস্তাবনার প্রাসঙ্গিক কাজ চলছে।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/জিকেএস