ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

রেকর্ড উৎপাদনের পরেও দেশে বাড়ছে চা আমদানি, কমছে রপ্তানি

নাজমুল হুসাইন | প্রকাশিত: ০৯:২৭ এএম, ২১ মে ২০২৪

গত বছর চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। ছোঁয় ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলক, যা ১৮৪ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এবছরও উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ভালো। রেকর্ড উৎপাদনের পর যেখানে রপ্তানি বাড়ার কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। রপ্তানি কমে বরং আমদানি বাড়ছে।

তথ্য বলছে, একসময় বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল চা। পাটের পরেই ছিল চায়ের অবস্থান। এখন সেই চিত্র আর নেই। সময়ের পরিক্রমায় রপ্তানিকারক দেশটি পরিণত হয়েছে চায়ের বড় আমদানিকারকে।

২১ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব চা দিবস। এই সময়ে এসে বাংলাদেশের উৎপাদন বাড়ায় বাড়তি চা রপ্তানিতে নজর দিতে তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রপ্তানি বাড়াতে চায়ের গুণগতমান আরও বাড়ানো প্রয়োজন। তাহলে রপ্তানি বাজারও সম্প্রসারিত হবে।

আমরা যেভাবে উৎপাদনে ভালো করছি, সেভাবে রপ্তানিতে এগিয়ে যেতে পারছি না। সেটা দুঃখজনক। বরং আমদানি বাড়ছে, তাতে অর্থ (বৈদেশিক মূদ্রা) খরচের চাপ বাড়ছে, সেটা ভালো নয়।- কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান

চা বোর্ডের তথ্য বলছে, দেশে চায়ের চাহিদা ৯ কোটি ২০ থেকে ৩০ লাখ কেজি। উৎপাদন বাড়ায় এখন বাড়তি চা রপ্তানি সম্ভব। গত বছর ১০ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়েছে। তবে ২০২০ সালে ২১ লাখ ৭ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়েছিল। এরপর দুই বছর টানা কমেছে রপ্তানি। ২০২১ সালে রপ্তানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৮ হাজার কেজি এবং ২০২২-এ ৭ লাখ ৮ হাজার কেজি। পরের বছর রপ্তানি কিছুটা বাড়ে। তবে মাত্র তিন বছর আগের তুলনায় এখনো রপ্তানি অর্ধেক।

ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে আমদানিতে। ২০২০ সালে দেশে ৬ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা আমদানি করা হয়। এরপর তা ক্রমে বেড়ে ২০২১ সালে ৭ লাখ ৪০ হাজার কেজি এবং ২০২২ সালে ১০ লাখ কেজিতে এবং শেষ ২০২৩ সালে প্রায় ১২ লাখ কেজি চা আমদানি হয়। এবছর আমদানি আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রেকর্ড উৎপাদনের পরেও দেশে বাড়ছে আমদানি, কমছে রপ্তানি

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যেভাবে উৎপাদনে ভালো করছি, সেভাবে রপ্তানিতে এগিয়ে যেতে পারছি না। সেটা দুঃখজনক। বরং আমদানি বাড়ছে, তাতে অর্থ (বৈদেশিক মুদ্রা) খরচের চাপ বাড়ছে, সেটা ভালো নয়।’

তিনি বলেন, ‘আমদানি নিরুৎসাহিত করতে চায়ের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা আছে। তারপরেও কিছু চা আসছে। কারণ কিছু ভালো মানের চা আমদানি হয়। সেগুলো খুবই উচ্চমানের চা, এর ভোক্তা উচ্চস্তরের। তবে সেখানেও আমাদের কাজ করতে হবে। মানোন্নয়ন করতে হবে। রপ্তানির চাগুলোও আরও ভালোমানের করতে হবে।’

রেকর্ড উৎপাদনের পরেও দেশে বাড়ছে আমদানি, কমছে রপ্তানি

চা ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, চায়ের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির জন্য খুব বেশি চা অবশিষ্ট থাকছে না। আর যে ধরনের চা বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে তার বেশিরভাগ ভিন্ন পদের। যেগুলো বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে না।

টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান শাহ মঈনুদ্দিন হাসান বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি বড় হওয়ার প্রেক্ষাপটে নগরায়ন বেড়েছে, যে কারণে বাড়ছে চায়ের ভোক্তা। অভ্যন্তরীণ বাজারেও চাহিদা উৎপাদন হারের মতোই বাড়ছে। যে কারণে বিশ্ববাজারের চেয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারেই ভালো দাম মিলছে চায়ের। ফলে রপ্তানিতে মনোযোগ কম।’

গত কয়েক বছর দেশের চায়ের ভোগ ক্রমে বাড়ছে। ২০১৫ সালে দেশে চায়ের ভোগের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৭০ লাখ কেজি। ২০২০ সালে এসে দাঁড়ায় ৮ কোটি ৬৬ লাখ কেজি এবং গত বছর ছিল সাড়ে ৯ কোটি কেজি।

চা আমদানিতে উচ্চ শুল্ক রাখা হয়েছে। বর্তমানে চা আমদানিতে ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ শুল্ক নির্ধারিত আছে। বলা হয়, চা আমদানি বন্ধ করতেই এত বেশি হারের শুল্ক স্তর। তারপরেও চাহিদার ভিন্নতার কারণে চা আমদানি বাড়ছে।- চা বোর্ডের সদস্য মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী

তবে চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান তানভীরুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে ভোগ বাড়লেও চা রপ্তানির বিকল্প নেই। শুধু উৎপাদন বাড়ালেই হবে না, পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মাথায় রেখে রপ্তানি বাড়াতে হবে। তবে এ শিল্পের টেকসই উন্নয়ন হবে। দেশে উৎপাদিত চায়ের ভালো দাম পাওয়া যাবে।’

বিশ্ব চা দিবস, রেকর্ড উৎপাদনেও দেশে রপ্তানি কমে বাড়ছে আমদানি

তিনি বলেন, ‘চা রপ্তানি করতে হলে মান বাড়াতে হবে। চট্টগ্রাম ও সিলেটের চায়ের মান ভালো হলেও উত্তরাঞ্চলে ক্ষুদ্র চাষ থেকে যে চা আসছে, সেগুলো খুব নিম্নমানের। এই নিম্নমানের চা নিলাম বাজারে দামের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।’

চা বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও বাণিজ্য) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘চা রপ্তানি বাড়াতে ৪ শতাংশ ক্যাশ ইনসেনটিভ দেওয়া হচ্ছে। বিদেশিদের সঙ্গে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। যাতে তাদের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন চা বাগানে উৎপাদন হয়। অপরদিকে চা আমদানিতে উচ্চ শুল্ক রাখা হয়েছে। বর্তমানে চা আমদানিতে ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ শুল্ক নির্ধারিত আছে। বলা যায়, চা আমদানি বন্ধ করতেই এত বেশি হারের শুল্ক স্তর। তারপরেও চাহিদার ভিন্নতার কারণে চা আমদানি বাড়ছে।’

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, বিশ্বে ৪৭টি দেশে চা উৎপাদিত হয়। লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটির সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অষ্টম। এক দশক আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দশম। বিশ্বব্যাপী চা উৎপাদনের ৩ শতাংশ বাংলাদেশে হয়।

বিশ্ব চা দিবস, রেকর্ড উৎপাদনেও দেশে রপ্তানি কমে বাড়ছে আমদানি

ওয়ার্ল্ডস্টপ এক্সপোর্টস অনুযায়ী, বিশ্ব রপ্তানিতে বাংলাদেশ বর্তমানে ৫৭তম। উৎপাদনে কাছাকাছি থাকলেও শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া চা রপ্তানিতে বাংলাদেশের তুলনায় বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছে। এখন চীন, জাপান, পাকিস্তান, ভারত, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ তেইশটি দেশে বাংলাদেশের চা যাচ্ছে। অর্থাৎ, বৈশ্বিক অবস্থানেও উৎপাদনের তুলনায় রপ্তানিতে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে চায়ের চাষাবাদ প্রথম শুরু হয় ১৮৪০ সালে। চট্টগ্রামে কুণ্ডদের বাগান (বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকা) নামে সেই চা বাগান অবশ্য সফলতার মুখ দেখেনি। এরপর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিন বছর পর সেই বাগান থেকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়।

চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, নব্বইয়ের দশকে চা রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। দেশীয় চায়ের গুণগত মান ভালো হওয়ায় বিদেশি ক্রেতাদের কাছে চায়ের চাহিদা ছিল বেশি। তাই তখন এ দেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় ওপরের দিকেই ছিল চা।

এনএইচ/এএসএ/জেআইএম