আর্থিক সংকটে বাড়ছে সাবলেটের চাহিদা
করোনা মহামারির অভিঘাতে আয় কমেছিল বহু মানুষের। অনেকে বাধ্য হয়ে তখন ছেড়ে গিয়েছিলেন ঢাকা শহর। সে ধাক্কা কিছুটা সামলে ওঠার আগেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্বজুড়ে দেখা দেয় আকাশচুম্বী মূল্যস্ফীতি। এবারও এর ধাক্কা লেগেছে কম আয়ের মানুষের জীবনে। সংকট সামলাতে একেকজন একেক পথ বেছে নিচ্ছেন। এমন সময়ে শহরজুড়ে চোখে পড়ছে ‘সাবলেট’।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরের একটি বড় অংশই এখন বেছে নিচ্ছেন সাবলেট। অনেকেই আবার পরিবার পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামে। অনেকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সাবলেট দিতে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। চাকরিজীবীদের বরাদ্দ পাওয়া ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রেও একই চিত্র চোখে পড়ছে। মূলত দ্রব্যমূল্যের বাড়তি চাপ সামাল দিতে সাবলেটের চাহিদা বাড়ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থাভাবে নগরে বসবাসকারীদের ‘কোয়ালিটি লাইফ’ কমে যাচ্ছে। এতে কমছে গড় আয়ু। এসব মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা নিরাপত্তায় সরকারি ব্যবস্থাপনা জরুরি। একই সঙ্গে নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। এটি না হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। দেশের বড় অংশ বেকার হবে, নষ্ট হবে কোটি কোটি শ্রমঘণ্টা।
দেশের একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে উপ-পরিদর্শক পদে কর্মরত মাহবুব। গুলবাগ এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন। দুই রুমের ফ্ল্যাটের জন্য প্রতি মাসে তাকে দিতে হচ্ছে ১৬ হাজার টাকা। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল মিলে ১৮ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। পরিবারে তারা দুজন। গ্রামে থাকেন বাবা-মা। তাদেরও কিছু টাকা দিতে হয়। মাস শেষে তার হাতে কোনো টাকাই থাকে না। কোনো কোনো মাসে ধারও করা লাগছে। এ অবস্থায় তিনি সিঙ্গেল পরিবার খুঁজছেন ফ্ল্যাটের এক রুম ভাড়া দেওয়ার জন্য। এজন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।
আরও পড়ুন>> ২০ হাজার টাকা আয়েও থাকতে হচ্ছে ঝুপড়ি ঘরে
মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, এর আগে চলেছি, ধার করার প্রয়োজন হয়নি। এখন সব কিছুর দাম অনেক বেশি হয়েছে। গ্রামে বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন। তাদের হাত খরচ, চিকিৎসা খরচ প্রয়োজন। সব মিলিয়ে চলছে না। এ কারণে স্ত্রীর পরামর্শেই ফ্ল্যাটের দুই রুমের একটি সাবলেট হিসেবে ভাড়া দিতে চাই। সেখান থেকে যা আসবে তাতে অন্তত সঞ্চয় না হলেও মাস শেষে ঋণ করা লাগবে না।
স্ত্রীর পরামর্শেই ফ্ল্যাটের দুই রুমের একটি সাবলেট হিসেবে ভাড়া দিতে চাই। সেখান থেকে যা আসবে তাতে অন্তত সঞ্চয় না হলেও মাস শেষে ঋণ করা লাগবে না।
শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে বরাদ্দ করা (সরকারি ফ্ল্যাট) ফ্ল্যাটে থাকেন মাসুম। তিনি রেলওয়েতেই চাকরি করেন। মাসুম জাগো নিউজকে বলেন, আমি চাকরি করে পরিবারের সবার প্রয়োজন মেটাতে পারছি না। তাদের চাহিদা ঠিক মতো পূরণ করতে পারি না। খাবার কিনতে গিয়ে পোশাক কেনা হচ্ছে না, এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। এ কারণে আমার ফ্ল্যাটের তিন রুমের দেড়রুম সাবলেট হিসেবে ভাড়া দিয়েছি। সেখান থেকে আমি অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা পাচ্ছি। এটা বৈধ নয়। তবুও টিকে থাকতে এছাড়া আমার পথ ছিল না। আমার বাবা-মা, পরিবারকে একটু সুখে রাখতে এটাই আমার অবলম্বন।
বেসরকারি চাকরিজীবীদের অবস্থা আরও খারাপ। বিশেষ করে কম বেতনের চাকরিজীবীদের অনেকেই সাবলেটের বিকল্প পাচ্ছেন না।
আরও পড়ুন>> অতিরিক্ত বাসা ভাড়ায় বাড়ছে সাবলেটের চাহিদা
কথা হয় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সায়েদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রায় দুই বছর ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে ছিলাম। আয় বাড়েনি, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে। বাচ্চাটাকে একটি স্কুলে ভর্তি করতে হবে। অনেকেই সাবলেট ছেড়ে ফ্ল্যাটে ওঠেন, আমি এখন ছোট ফ্ল্যাট ছেড়ে সাবলেটে উঠছি। ফ্ল্যাটে থাকলে বাচ্চাকে ভালো একটা স্কুলে দিতে পারবো না। তাছাড়া খাওয়া খরচ এখন দ্বিগুণ হয়েছে।
অনেকেই আবার বিয়ে করেও মেস থেকে বের হতে পারছেন না। পরিবার নিয়ে নগরে থাকার চিন্তাও ‘স্বপ্নের মতো’ তাদের কাছে। এম জেড আবেদিন, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় একটি মেসে থাকেন। বিয়ে করেছেন মাস ছয়েক আগে। গ্রামে অসুস্থ বাবা-মার সঙ্গেই স্ত্রী রয়েছেন।
আবেদিন জাগো নিউজকে বলেন, যা আয় তা দিয়ে ভালোভাবে চলা কষ্ট। সাবলেট বা ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখছি না আপাতত।
নগরবাসীর স্বাস্থ্য-চিকিৎসা-শিক্ষা বিষয়ে কথা হয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, যারা ঢাকায় থাকেন তাদের একটি বড় অংশই নিম্ন বা মধ্যবিত্ত। তাদের আয়ের বড় অংশই থাকা বা খাবার খরচে চলে যায়। এতে তারা খাদ্য-শিক্ষা-চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এদের জীবনের মান কমে যাচ্ছে। এতে গড় আয়ুও কমে যায়। এসব মানুষের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিরাপত্তায় সরকারি ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার। নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। এটি না হলেও দেশের বড় অংশ বেকার হবে। কোটি কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হবে। অর্থনীতিতে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।
আরও পড়ুন>> বস্তিতে বসবাসের হার বেশি সিলেটে, কম চট্টগ্রামে
ঢাকা শহরের মানুষ কেমন বাসায় থাকছেন, এ বিষয়ে গবেষণা করেছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। রিহ্যাবের গবেষণা সেল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, ধানমন্ডি, হাজারিবাগ, মিরপুর, গুলশান, বনানী ও উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় গবেষণাটি পরিচালনা করে। গবেষণাটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় যাদের আয় ২০ হাজার বা ২০ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ভরসা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে কোনো ঝুপড়ি ঘর। এ ঘরে পরিবার নিয়ে কোনোরকমে থাকছেন তারা। যাদের আয় ২১ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা তারা থাকছেন ৬ থেকে ১০ হাজার টাকায়, সাবলেট।
ঢাকায় যাদের আয় ২০ হাজার বা ২০ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ভরসা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে কোনো ঝুপড়ি ঘর। এ ঘরে পরিবার নিয়ে কোনোরকমে থাকছেন তারা। যাদের আয় ২১ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা তারা থাকছেন ৬ থেকে ১০ হাজার টাকায়, সাবলেট।
৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকা যাদের আয়, তারা থাকছেন ছোট আকারের কোনো ফ্ল্যাটে। যেগুলোর ভাড়া ১১ থেকে ১৪ হাজার টাকার মধ্যে। যাদের আয় ৪১ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে তারা থাকছেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ফ্ল্যাটে। যেগুলোর আয়তন ১১০০ থেকে ১১৫০ স্কয়ার ফুট। ৫১ থেকে ৮০ হাজার টাকা আয়ের মানুষের ভরসা ১১৫০ থেকে ১২০০ স্কয়ার ফুটের কোনো ফ্ল্যাট, যেগুলোর ভাড়া ২১ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে। ৮০ থেকে এক লাখ টাকা আয়ের মানুষ থাকছেন ১২০০ থেকে ১৫০০ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাটে- যেগুলোর ভাড়া ৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে। তবে ভালো মানের ১৫০০ স্কয়ার ফুট বা তারচেয়ে একটু বড় কোনো বাসায় থাকতে হলে অবশ্যই এক লাখ টাকার বেশি তাকে আয় করতে হবে। যেগুলোর ভাড়া ৪০ হাজার টাকা বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি।
সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, বাসযোগ্য নগরী গড়তে এলাকাভিত্তিক ম্যাপিং করে শহরকে বসবাসের উপযোগী করা যায়। আবার ওয়ার্ডভিত্তিক নগর পরিকল্পনা প্রণয়নে টেকসই নগর গড়ে তোলা সম্ভব। এজন্য সব শ্রেণির আয়ের মানুষের জন্য বাসযোগ্য নগর প্রয়োজন। লাখ লাখ মানুষের বসবাস এড়িয়ে কোনো উন্নয়ন সম্ভব হবে না। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসনের প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে।
ঢাকায় আবাসনেই আয়ের অর্ধেক চলে যাচ্ছে সাধারণের। এতে সংসারে খরচ চালাতে গিয়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে। এ সমস্যা সমাধানে সরকারের ভাবনার বিষয়ে কথা হয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রণীত নতুন ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা মধ্যবিত্তদের জন্য ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এলাকাভিত্তিক এক লাখ অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা করছি। এটি ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারবো।
ইএআর/এমএইচআর/এমএস