বিলুপ্তির পথে তাঁত, ঐতিহ্য হারাচ্ছে রুহিতপুরী লুঙ্গি
ঐতিহ্যের আদিকাল থেকে গ্রামবাংলার আরামদায়ক পোশাকের মধ্যে অন্যতম কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরী লুঙ্গি। কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দা-রুহিতপুর গ্রামের এ লুঙ্গির কদর দেশজুড়ে। মেশিন নয়, রুহিতপুরী তাঁতের লুঙ্গি সম্পূর্ণ নিখুঁত হস্তশিল্প। তবে, সরকারি সুযোগ-সুবিধা তেমন না থাকায় তাঁতশিল্প থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন এখানকার উদ্যোক্তারা। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে রুহিতপুরী লুঙ্গি।
জানা যায়, এক সময় এ গ্রামে প্রায় তিন হাজারের বেশি তাঁত ছিল। রুহিতপুরী লুঙ্গি তৈরির তাঁতের খটখট শব্দ আশপাশের কয়েক গ্রামে শোনা যেত। সময়ের পরিক্রমায় এসব এলাকায় এখন পিনপতন নীরবতা। বর্তমানে শিল্পায়নের যুগে নতুন নতুন প্রযুক্তি পাশাপাশি সুতা, রং ও লুঙ্গি তৈরিতে প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া ও তাঁতের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে হাতে বোনা এ তাঁতের লুঙ্গি। দিন-রাত তাঁতের খটখট আওয়াজ কমে যাওয়া তা-ই জানান দিচ্ছে।
কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দা রুহিতপুর গ্রামের তাঁতি শরিফ ব্যাপারীর কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি ঝুপড়ি ঘর। তার ভেতরে হাতে লুঙ্গি বুনছেন পাঁচজন তাঁতি। তাঁতিদের এক হাতে সানা লাগানোর কাঠের হাতল। অন্য হাতে সুতা গাঁথার রশি দিয়ে খটখট শব্দে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। ঘরের বাইরে উঠানে সুতায় রং লাগানোসহ আনুষঙ্গিক কাজ করছেন আরও চারজন। কেউ আবার সুতার আঁশ ছাড়াচ্ছেন। কেউ রং লাগাচ্ছেন। প্রতিটি মানুষের নিখুঁত পরিশ্রমে তৈরি হচ্ছে রুহিতপুরী লুঙ্গি।
আরও পড়ুন>> তাঁতিদের স্বার্থের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি চক্র
সেখানে কয়েকজন তাঁতির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পূর্বপুরুষের পেশা ধরে রাখতে এখনো তাঁতের কাজ করে যাচ্ছেন। আগের মতো আয় না থাকায় আগ্রহ হারিয়ে অনেকে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। লুঙ্গি বুনে যে আয় তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
‘আবু হোসেন নামে আরেক তাঁতি বলেন, পূর্বপুরুষরা এ কাজ করে গেছেন, আমরাও করছি। দিন-রাত মিলিয়ে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করি। এখন আগের মতো আয় নেই। তাই আমাদের প্রজন্মের পর রুহিতপুরের হাতে বোনা লুঙ্গি পাওয়া কষ্টকর হবে।’- তাঁতি আবু হোসেন।
৩৫ বছর ধরে রুহিতপুরী লুঙ্গি তৈরির কাজ করছেন তাঁতি মাহবুব হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, দিন-রাত ১৪ ঘণ্টা কাজ করি। দেড় দিনে এক থান লুঙ্গি তৈরি করা যায়। আয় ৬০০ টাকা। প্রতিদিন গড়ে ৪০০ টাকা আয় হয়। একদিনে এর চেয়ে বেশি কাজ করা সম্ভব নয়। যে পরিশ্রম করি সে অনুযায়ী টাকা পাই না। মাঝে এ কাজ ছেড়ে বিদেশ গিয়েছিলাম। এরপর দেশে এসে অন্য কোনো কাজ না পেয়ে বাধ্য হয় এ কাজই করছি।
আরও পড়ুন>> বিলুপ্তির পথে মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত
আবু হোসেন নামে আরেক তাঁতি বলেন, পূর্বপুরুষরা এ কাজ করে গেছেন, আমরাও করছি। দিন-রাত মিলিয়ে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করি। এখন আগের মতো আয় নেই। তাই আমাদের প্রজন্মের পর রুহিতপুরের হাতে বোনা লুঙ্গি পাওয়া কষ্টকর হবে।
‘৮০০ থেকে ১৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে রুহিতপুরী লুঙ্গি। এতে তাঁতিদের সেভাবে মজুরি দেওয়া যায় না। সরকার যদি এ শিল্প রক্ষায় উদ্যোগ নিয়ে সুতা, রং ও অন্য আনুষঙ্গিক কাঁচামালের দাম কমিয়ে দেয় তাহলে আয় বাড়বে। আর আয় বাড়লে তাঁতিরাও লুঙ্গি তৈরিতে উৎসাহিত হবেন।’-তাঁতি শরিফ হোসেন।
রুহিতপুরের তাঁতিদের সূত্রে জানা যায়, নিজেরাই লুঙ্গি তৈরির নকশা করেন। এক থান লুঙ্গি বুনতে দুই কেজির মতো সুতা লাগে। এসব লুঙ্গি বোনা হয় ৮৪ কাউন্টের সুতা দিয়ে। ফলে লুঙ্গি হয় টেকসই।
আরও পড়ুন>> কলাবতী শাড়ি বানিয়ে দেশব্যাপী আলোচিত মৌলভীবাজারের রাধাবতী
রুহিতপুরী লুঙ্গির দামের বিষয়ে তারা জানান, রুহিতপুরীর লুঙ্গি আগে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হলেও দিনের পালাবদলে দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। এখন বাহারি রঙের লুঙ্গি ১ হাজার টাকার ওপরে। কালার ছাড়াগুলো ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। তাই বলা যায়, প্রকারভেদে ৮০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকার মধ্যে রুহিতপুরীর লুঙ্গি পাওয়া যায়।
শরিফ ব্যাপারীর কারখানার ম্যানেজার মো. রফিক জাগো নিউজকে বলেন, ১৩ থেকে ১৫টি ধাপ পেরিয়ে একটি লুঙ্গি হয়। ১৮ জন তাঁতি এ কাজের সঙ্গে জড়িত। প্রতি থান লুঙ্গি তৈরির পেছনে খরচ হয় ২ হাজার ৭০০ থেকে ৩ হাজার টাকার মতো। একজন শ্রমিক কোনো মাসে ১০ হাজার, কোনো মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করেন।
আরও পড়ুন>> ৮৫ জনকে চাকরি দেবে তাঁত বোর্ড
তিনি বলেন, এ কারখানায় মাসে ২৫০ থেকে ৩০০ লুঙ্গি তৈরি হয়। আমাদের লুঙ্গি দেশ-বিদেশে সব জায়গায় চলে যায়। রুহিতপুরের লুঙ্গি আমাদের থেকে নিয়ে যারা বিক্রি করে তাদের লাভ বেশি। আমাদের থেকে পাইকারি নিয়ে খুচরা প্রতি পিস লুঙ্গিতে তারা ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাতে না বুনে পাওয়ারলুম ও হ্যান্ডলুমে লুঙ্গি তৈরি করে রুহিতপুরের বলে চালিয়ে দেয়। অথচ এসব লুঙ্গি তাঁতে তৈরি নয়।
আরও পড়ুন>> মজুরি কম, ঈদেও নেই বোনাস
রুহিতপুরীর লুঙ্গির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন রহিতখালীর তাঁতি শরিফ হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার তিন পুরুষ তাঁতি। বাংলাদেশে লুঙ্গি তৈরির শুরু রুহিতপুর থেকে। রুহিতপুরী লুঙ্গি ব্রিটিশ আমল থেকে জনপ্রিয়। আমার দাদার আমলে এ এলাকায় সাড়ে তিন হাজার তাঁত ছিল। সময়ের পরিক্রমায় এখন ১০ থেকে ১২ টি তাঁত আছে। তাই এ পেশা বিলুপ্তের পথে। প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেশি হওয়ায় লুঙ্গি তৈরিতে উৎসাহ হারাচ্ছেন তাঁতিরা।
শরিফ হোসেন বলেন, আমি তাঁতির সন্তান হিসেবে ঐতিহ্য ধরে রাখতে কয়েকটা তাঁত চালু রেখেছি। এখন বাংলাদেশে দেখা যায় সব জায়গায় রুহিতপুরী নামে লুঙ্গি বিক্রি হয়। তারা আমাদের সিল মেরে নকল লুঙ্গি বিক্রি করে। আসল রুহিতপুরী লুঙ্গির দাম ৯০০ টাকার ওপর। এখনো দূর-দূরান্ত থেকে রুহিতপুরী লুঙ্গির জন্য অনেক কাস্টমার আসেন। যারা আসল রুহিতপুরী লুঙ্গি পরেন তারা আমাদের কাছেই আসেন।
আরও পড়ুন>> লাল ফিতায় যেন তাঁতিদের উন্নয়ন আটকে না যায়: বস্ত্রমন্ত্রী
তিনি বলেন, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের লুঙ্গি ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর রুহিতপুরী লুঙ্গি ৮০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। তা তাঁত শ্রমিকদের সেভাবে মজুরি দেওয়া যায় না। সরকার যদি এ শিল্প রক্ষায় উদ্যোগ নিয়ে সুতা, রং ও লুঙ্গি তৈরিতে আনুষঙ্গিক কাঁচামালের দাম কমিয়ে দেয় তাহলে আয় বাড়বে। আর আয় বাড়লে তাঁতিরাও লুঙ্গি তৈরিতে উৎসাহিত হবেন।
আরও পড়ুন>> কোমর তাঁতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন পাহাড়ের ৭০ নারী
আরএএস/এমএএইচ/এএসএম