ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

বিক্রয়কর্মী থেকে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির মালিক

ইয়াসির আরাফাত রিপন | প্রকাশিত: ০৫:৫১ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০২৩

স্বাধীনতার প্রায় এক দশক পরের কথা। বাংলাদেশের অর্থনীতি তখনও ধুঁকছে। ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। শিল্পে তখনও সেভাবে বিনিয়োগ শুরু হয়নি। এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই করে বিনিয়োগের সাহস দেখান একজন বিদেশি। এরপর কেটে গেছে আরও চার দশক। বিশাল জনগোষ্ঠী, ভৌগোলিক অবস্থান, উর্বর মাটি ও সঠিক নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। আর বাংলাদেশের এ উন্নয়ন যাত্রায় সঙ্গী দক্ষিণ কোরিয়ান নাগরিক কিহাক সাং। বিক্রয়কর্মী থেকে যার গড়া কোম্পানি ছুঁয়েছে বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক।

কিহাক সাং মানেই সংগ্রাম আর সফলতার গল্প। নিজের প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ানের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রায় ৬শ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন কিহাক সাং। শুরু থেকেই কারখানায় উন্নত প্রযুক্তি সংযোজনের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরিতে মনোযোগ দেন তিনি। এতে ইয়াংওয়ানের রপ্তানি বাড়তে থাকে ধারাবাহিকভাবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে এ প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি করেছে এক বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পোশাক। এ কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বাংলাদেশের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক।

আরও পড়ুন>> রপ্তানি আয়ে রেকর্ড, তৈরি পোশাক থেকেই এলো ৮২ শতাংশ

যেভাবে শুরু

পেশাগত জীবনে সফল এ ব্যক্তির জীবনের শুরুটা ছিল সাদামাটা। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথা অনুযায়ী সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে ১৮ মাসের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন একটি পোশাক কোম্পানিতে সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে। দুই বছর সেলসম্যান হিসেবে কাজ করার পর ১৯৭৪ সালে দুই অংশীদার নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ইয়াংওয়ান করপোরেশন। পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানির লক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে স্থাপন করেন ইয়াংওয়ানের প্রথম কারখানা।

jagonews24

ইয়াংওয়ানের কর্মক্ষেত্র

বাংলাদেশ অধ্যায়ে কিহাক সাং

কিহাক সাংয়ের বাংলাদেশ অধ্যায় শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। ওই বছর তিনি চট্টগ্রামে সফর করেন। উদ্দেশ্য ছিল পোশাক কারখানা স্থাপন করার সম্ভাব্যতা যাচাই। তবে ওই সময় জায়গাটিকে তেমন সম্ভাবনাময় মনে হয়নি। দুর্বল অবকাঠামোর পাশাপাশি শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতিও ছিল না। তবে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার ছিল। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাংলাদেশকেই বেছে নেন কিহাক সাং। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশি অংশীদারদের নিয়ে ইয়াংওয়ান বাংলাদেশ লিমিটেড নামে স্থাপন করেন নিজের কারখানা।

টেক্সটাইল কোম্পানির জন্য পণ্য বিক্রি করছিলাম আমি। সেলসম্যানের কাজ হলো গ্রাহকদের সঙ্গে দেখা করা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, নমুনা পণ্য বা ডিজাইন নেওয়া, নমুনা বানানো বা এর বাণিজ্যিকীকরণ। সবশেষ ক্রেতার অনুমোদন আদায় আর উৎপাদনের শিডিউল ও মানের তত্ত্বাবধান করা। এটা শুধু বিক্রি নয়, একটা পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা।

বিশ্বজুড়ে কর্মী ৮৫ হাজার, ৭০ হাজারই বাংলাদেশের

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কিহাক সাংয়ের ইয়াংওয়ান করপোরেশনে প্রায় ৮৫ হাজার লোক কর্মরত, যার মধ্যে ৭০ হাজার কাজ করেন বাংলাদেশে। ইয়াংওয়ানের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। টার্নওভারের এক-তৃতীয়াংশ আসে বাংলাদেশ থেকে। বর্তমানে ভিয়েতনাম, উজবেকিস্তান, এল সালভাদর ও ইথিওপিয়ায় কারখানা আছে কিহাকের কোম্পানির। তবে তার সবচেয়ে বড় স্থাপনা বাংলাদেশের কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড), যার পরিধি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

jagonews24

ইয়াংওয়ানের কর্মী

আরও পড়ুন>> বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দার মধ্যেও ৪৭৯০ কোটি টাকার মাছ রপ্তানি

একটি শিল্পাঞ্চল কেমন হওয়া উচিত, তার উদাহরণ হতে পারে কিহাকের কেইপিজেড। ২৫ কিলোমিটার রাস্তার নেটওয়ার্ক সম্বলিত দুই হাজার ৫শ একরেরও বেশি জমিজুড়ে বিস্তৃত কেইপিজেডের ভূমির অর্ধেকেরও বেশি জুড়ে আছে বন ও জলাধার। রয়েছে ৮৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ১৩৭ প্রজাতির পাখি। কঠোর পরিশ্রম ও টেকসই পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে যে কেউ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে- এর বড় উদাহরণ কিহাক সাং। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে বিদেশিদের বিনিয়োগের উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই কোরিয়ান নাগরিক।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কিহাক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘টেক্সটাইল কোম্পানির জন্য পণ্য বিক্রি করছিলাম আমি। সেলসম্যানের কাজ হলো গ্রাহকদের সঙ্গে দেখা করা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, নমুনা পণ্য বা ডিজাইন নেওয়া, নমুনা বানানো বা এর বাণিজ্যিকীকরণ। সবশেষ ক্রেতার অনুমোদন আদায় আর উৎপাদনের শিডিউল ও মানের তত্ত্বাবধান করা। এটা শুধু বিক্রি নয়, একটা পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা। কিছু করতে হলে বেসরকারি উদ্যোগেই করতে হয়। কারণ বেসরকারি খাতই জানে কীভাবে দ্রুততম সময়ে কোনো কাজ করা যায়।

jagonews24

ইয়াংওয়ানের তৈরি পোশাকে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’

আরও পড়ুন>> বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বেশি দামে কিনবে বৈশ্বিক ক্রেতারা

শীর্ষ পোশাকপণ্য রপ্তানিকারক ইয়াংওয়ান
সদ্য বিদায়ী (২০২২-২৩) অর্থবছরে দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানি ইয়াংওয়ান সর্বোচ্চ ১০০ কোটি ডলারের পোশাকপণ্য রপ্তানির মাইলফলক ছুঁয়েছে। ইয়াংওয়ান শুরু থেকেই কারখানায় উন্নত প্রযুক্তি সংযোজনের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরিতে মনোযোগ দেয়। এতে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। তারাই বর্তমানে বাংলাদেশের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক।

যেভাবে আজকের ইয়াংওয়ান
হাজারো চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেন কিহাক সাং। ১৯৮০ সালের মে মাসে বাংলাদেশি অংশীদারদের নিয়ে ইয়াংওয়ান বাংলাদেশ লিমিটেড নামে নিজের কারখানা স্থাপন করেন। কারখানায় তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ঝামেলামুক্ত রাখার সংস্কৃতি নিয়ে আসেন। শুরুতেই সুইডিশ ক্রেতার ক্রয়াদেশ ছিল। এক ব্যাচ সাধারণ পোশাকের অর্ডার ছিল সেটি। কিহাক সাংয়ের কারখানায় শুরুতে ২৫০ জন শ্রমিক ছিল। যাদের সবাইকে অভিজ্ঞ কোরিয়ান অপারেটর দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর ১৯৮৪ সাল নাগাদ কিহাকের কোম্পানি ১৮ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে।

এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি কিহাক সাংকে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ইয়াংওয়ান করপোরেশনে প্রায় ৮৫ হাজার লোক কর্মরত। সিউল স্টক মার্কেটের তালিকাভুক্ত তার কোম্পানির (ইয়াংওয়ান) বার্ষিক টার্নওভার তিন বিলিয়ন ডলার। তার আয়ের এক-তৃতীয়াংশই আসে বাংলাদেশ থেকে।

jagonews24

ইয়াংওয়ানের তৈরি পণ্য

ইয়াংওয়ান দামি আইটেমে ব্যবহৃত হাই-টেক কৃত্রিম ফাইবারে বিনিয়োগ করছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অন্য পোশাকশিল্পের জন্য কৃত্রিম ফাইবারের অন্যতম উৎস হবে এটি।

বর্তমানে কেইপিজেডে এরই মধ্যে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, কৃত্রিম (ম্যানমেইড) ফাইবার, জুতা, ব্যাগ ও অন্য পণ্য উৎপাদনের ৪০টি শিল্প ইউনিট রয়েছে। রপ্তানিতে ইয়াংওয়ানের মূল্য সংযোজন গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ। কিছু আইটেমের বেলায় তা ৯৫ শতাংশ। দেশের অন্য ইপিজেডেও ইয়াংওয়ানের কিছু কারখানা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সম্পদ রয়েছে আনোয়ারার কেইপিজেডে। প্রতি বছর নতুন নতুন শিল্প কমপ্লেক্স যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হচ্ছে ইয়াংওয়ান করপোরেশন।

ইএআর/এএসএ/এমএস