সংকুচিত হচ্ছে হস্তচালিত বেকারির ব্যবসা, টিকে থাকা দায়
দেশে একসময় আটা-ময়দাজাত পণ্যের চাহিদার প্রায় পুরোটাই সরবরাহ করতো পাড়া-মহল্লার হস্তচালিত বেকারিগুলো। এখন এটা বড় বড় শিল্পগ্রুপের দখলে। নতুন করে আনাচে-কানাচের কনফেকশনারির দোকানগুলো হয়ে উঠছে একেকটি লাইভ বেকারি। এতে দুরবস্থায় পুরোনো বেকারিগুলো। রয়েছে আরও কিছু সমস্যা। এসব নিয়ে জাগো নিউজের তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
প্রিয়া বেকারি। ভোক্তাদের কাছে অনেকটা বিশ্বস্ত নাম। একসময় খিলগাঁও-বাসাবো এলাকা থেকে শুরু করে সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পণ্য সরবরাহ করতো প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে কেটে গেছে ৩০ বছর। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী একাধিক কারখানা ভাড়া দিয়েছেন অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে। তিন দশকের হাতে তৈরি বেকারির ব্যবসা এখন প্রায় বন্ধ। যেটুকু চলছে সেটা ধুঁকে ধুঁকে।
বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর বিনিয়োগ, নতুন করে লাইভ বেকারির প্রচলন শুরু হওয়াসহ নানান কারণে পিছিয়ে পড়ছে হস্তচালিত বেকারিগুলো। অনেকে বাধ্য হয়েছেন কারখানা বন্ধ করতে। যারা কোনো রকমে টিকে আছেন তারাও খুঁজছেন বিকল্প পথ।
প্রিয়া বেকারির প্রতিষ্ঠাতা জাফর আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, “করোনার পর আমরা যখন সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছি তখন দেশে ‘লাইভ বেকারির’ প্রচলন বেড়েছে। আবার বড় বড় শিল্পগ্রুপ এ খাতে বিনিয়োগ করছে। তাদের পণ্য পৌঁছে গেছে দেশের সর্বত্র। যেখানে আমরা টিকতে পারছি না।”
আরও পড়ুন>> অর্ডার দিলেই হাজির গরম গরম পাউরুটি-কেক
জাফর আহম্মেদ বলেন, ‘শুধু আমার ব্যবসা খারাপ সেটা নয়, হস্তচালিত সব বেকারির ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। এখন আমরা ব্যাংক ঋণের কিস্তি দিতে পারছি না। সাপ্লায়ারের বিল আটকা আছে। আগে ঢাকার সব শোরুমে পণ্য যেত, এর মধ্যে আমার পণ্য যেত কয়েকশো শোরুমে। এখন দু-এক রয়েছে। এ দিয়ে কোনোভাবে টিকে আছি।’
হস্তচালিত বেকারির বিভিন্ন পণ্য/জাগো নিউজ
তথ্য বলছে, দেশে দুই ধরনের বেকারি রয়েছে। একটি হস্তচালিত (হাতে তৈরি নন-ব্র্যান্ড) বেকারি। দেশে ছোট-বড় পাঁচ হাজার এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা হাতে তৈরি পণ্য দেশের পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করেন। অন্য ধরনটি অটো ও সেমি-অটো বেকারি। দেশে ১০০টির মতো এ ধরনের বেকারি রয়েছে, যা স্বয়ংক্রিয় কারখানায় পণ্য তৈরি করছে। এদের মধ্যে ৫০টি মাঝারি আকৃতির, ৩৫টির মতো কারখানা বড়। এছাড়া দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী আরও প্রায় ১৫টি কারখানা করেছে। যেগুলো এখন বেকারি ব্র্যান্ড। আকিজ, প্রাণ, ফ্রেশ এদের মধ্যে অন্যতম।
গত প্রায় এক দশকে সার্বিক বেকারির বাজার বড় হলেও সে সুযোগ নিতে পারেনি হাতে তৈরি সনাতন বেকারিগুলো। এখন টিকে থাকাই তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রুটি, বিস্কুট ও কেক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতেই গত বছর আটা, ময়দা, সয়াবিনসহ এ খাতের সব ধরনের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম অনেক বেড়ে যায়। সে সময় দাম সমন্বয় করলেও তাদের পণ্যের চাহিদা কমে গেছে।
আরও পড়ুন>> সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে চাল-আটা-ডাল-বেকারি পণ্যের
বাজার চলে গেছে অটো, সেমি-অটো বেকারিগুলোর হাতে। এছাড়া গত বছর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, ক্রমাগত বাড়ছে কর্মীদের বেতন। পাড়া-মহল্লায় লাইভ বেকারিগুলোর বেচাকেনাও বেড়েছে। সেটারও একটি প্রভাব পড়ছে হস্তচালিত বেকারির ওপর।
হস্তচালিত বেকারির বিভিন্ন পণ্য/জাগো নিউজ
হস্তচালিত বেকারির সংগঠন বাংলাদেশ রুটি-বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতি। সংগঠনের তথ্যমতে, করোনার আগে সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার বেকারি ছিল। মহামারিকালে হাজারখানেক সাময়িকভাবে বন্ধ হয়। পরিস্থিতির উন্নতি হলে অনেকে ব্যবসায় ফেরেন। তারপরও প্রায় ২০০ বেকারি স্থায়ীভাবে ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ে। এছাড়া এক-তৃতীয়াংশ বেকারি তাদের উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশ রুটি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন কেউ আগের মতো উৎপাদন করতে পারে না। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেকারি এখন একদম রুগণ। সবাইকেই আগের চেয়ে উৎপাদন কমাতে হয়েছে। দায়সারাভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বেকারির সার্বিক বাজার এসময় বড় হয়েছে। সেখানে আমরা কোনো অবদান রাখতে পারছি না। সুফল নিচ্ছে বড় বড় কোম্পানি।’
তিনি বলেন, ‘এ খাতের অধিকাংশ ব্যবসায়ী স্বল্পশিক্ষিত। তাদের অন্য কিছু করার উপায় নেই। বাধ্য হয়েই তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখছেন কখনো যদি সুদিন আসে সেই আশায়।’
আরও পড়ুন>> দাম বাড়ায় ক্রেতা কমছে বেকারি পণ্যের
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার আগে হস্তচালিত বেকারির পণ্যের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ থেকে ২০ শতাংশ, যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। কিন্তু করোনার বিধিনিষেধ শিথিল করার পর এ খাতে প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে। এরপর থেকে প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। এখন এটি ছয় থেকে আট শতাংশের বেশি হবে না।
হস্তচালিত বেকারির বিভিন্ন পণ্য/জাগো নিউজ
বেকারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল হক জাগো নিউজক বলেন, ‘বাজারে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। ছোট ছোট অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক বেকারিগুলোর বাজার বড় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির হাতে চলে গেছে। আকিজ, ফ্রেশ, অলিম্পিক, হক, নাবিস্কো, ড্যানিশ, রোমানিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ছোট ব্যবসায়ীদের নেই।’
তিনি বলেন, ‘একটি বেকারি করতে ন্যূনতম কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এরপর কারখানার ভাড়া, শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন, বিপণন খরচ ছাড়াও গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির খরচ রয়েছে। এখন যে বিক্রি তাতে এ খরচই উঠছে না। বাধ্য হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হচ্ছে।’
রেজাউল হক বলেন, ‘যে বেকারিতে একদম কম উৎপাদন হয়, তারও বাণিজ্যিক লাইনে গ্যাসের বিল আসে ৪০ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ ও পানির বিল ৪০ হাজার। এছাড়া বিক্রি থাকুক না থাকুক শ্রমিক-কর্মীদের বেতন দিতে হবে। সারাদেশের বেকারিগুলো প্রায় একই মডেলে চলে, কেনাবেচা কমলেও প্রতিষ্ঠানগুলোও খরচের বড় চাপে রয়েছে।’
রামপুরা এলাকায় বেশ জনপ্রিয় কুইন বেকারি। এ বেকারির বিক্রিও কমেছে। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক এখলাস হোসেন বলেন, ‘বাপ-দাদার ব্যবসা। কয়েক বছর লোকসান হলেও চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু ব্যবসার পরিস্থিতি এখন নেই। খুব খারাপ অবস্থা। বাজার সংকুচিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।’
হস্তচালিত বেকারি মালিকরা এ-ও বলছেন, অনেক ব্যবসায়ী ঢাকায় তাদের ব্যবসা টেকাতে না পেরে গ্রামগঞ্জে কারখানা সরিয়ে নিচ্ছেন। ঢাকার বাইরেও এ ব্যবসার চাপ রয়েছে, তবে তুলনামূলক কম।
এনএইচ/এএসএ/এমএস