ঋণের শর্ত পূরণে কতটা অগ্রগতি, আইএমএফকে জানাবে এনবিআর
বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এরই মধ্যে প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় হওয়ার কথা আগামী নভেম্বরে। তবে ঋণের শর্ত কতটা পূরণ হলো, তা দেখতে ঢাকায় অবস্থান করছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। মিশনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইএমএফের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ।
আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করবে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এসময় তারা সরকারের এক ডজনের বেশি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গেও বৈঠক করবে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বৈঠকে আইএমএফকে শর্ত পালনে নিজেদের অগ্রগতির কথা জানাবে এনবিআর।
জানা গেছে, মিশন সদস্যরা তাদের রিপোর্ট আইএমএফের আঞ্চলিক নির্বাহী পরিচালক ড. কৃষ্ণমূর্তির কাছে হস্তান্তর করবেন। আগামী ১৮ অক্টোবর ঢাকায় আসছেন ড. কৃষ্ণমূর্তি। সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন।
আরও পড়ুন: নতুন মডেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসন চায় আইএমএফ
চলতি বছরের শুরুতে শর্তসাপেক্ষে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয় আইএমএফ। এরপর ওই শর্ত কতটা পালন করছে সরকার তা দেখতে দুইবার ঢাকা আসে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইএমএফের শর্তানুযায়ী ভর্তুকি কমানো, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, রাজস্ব খাতে সংস্কারসহ একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে সংস্কার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে এনবিআরসহ সরকারের একাধিক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দিনব্যাপী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস নীতি শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে প্রতিনিধিদল। এরপর ৯ অক্টোবর বৈঠক হবে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে। বৈঠকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রগতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে।
আইএমএফের সঙ্গে আসন্ন বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশের কী জবাব হবে তা নিয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে অর্থবিভাগে বৈঠক করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এতে অংশ নেন এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, জ্বালানি বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন: ঋণের শর্ত কতটা পূরণ হলো, জানতে অক্টোবরে আসছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল
সূত্র জানায়, আইএমএফকে শর্ত পালনে নিজেদের অগ্রগতির কথা জানাবে এনবিআর। ৫ ও ৯ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় বৈঠকের কার্যবিবরণী বিশ্লেষণে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ের পরিকল্পনা, ইএফডি স্থাপনের অগ্রগতি, ভ্যাট প্রশাসনে সংস্কার, সম্ভাব্য কর্মসূচি, বেঞ্চমার্ক, প্রযুক্তিগত সহায়তা, সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ আরও কিছু বিষয় আইএমএফকে জানাবে ভ্যাট বিভাগ। একই সঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরের আয়কর ও শুল্ক আদায়ের তথ্যও তুলে ধরা হবে।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের পরিকল্পনা, কমপ্লায়েন্স রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের স্থিতি, কাস্টমস রাজস্ব প্রশাসনে সংস্কার, নতুন জাতীয় শুল্কনীতি এবং শুল্ক যৌক্তিকীকরণের পরিকল্পনা নিয়ে আইএমএফকে জানাবে আয়কর ও শুল্ক বিভাগ। এছাড়া কারিগরি সহায়তা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, করব্যয় মূল্যায়ন, করনীতি সম্পর্কে ফলোআপ, আয়কর আইনের সাম্প্রতিক সংশোধনী এবং রাজস্ব আদায়ে প্রত্যাশিত প্রভাব নিয়েও জানাবে সংস্থাটি। আগামী ৯ অক্টোবর এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করবে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বৈঠকে কাস্টমস আইনের অগ্রগতি, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এবং নতুন আয়কর আইনের কারণে রাজস্ব আদায়ে কতটা প্রভাব পড়বে, এমন বেশকিছু বিষয় জানতে চাইবে আইএমএফ।
গত (২০২২-২৩) অর্থবছরে আইএমএফ নির্দেশিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা কম আদায় করেছে এনবিআর। আবার চলতি অর্থবছর জিডিপির অনুপাতে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে এনবিআরকে। সেই হিসাবে এ বছর ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে হবে। কিন্তু, অর্থবছরের দুই মাসে রাজস্ব আয়ে ঘাটতি ৪ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ৪৬ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। ফলে রাজস্ব আদায়ের প্রতিশ্রুতি পূরণে এখনো পিছিয়ে এনবিআর।
আরও পড়ুন: এনবিআরে বিপিসির বকেয়া জেনে ‘অবাক’ আইএমএফ
সূত্র জানায়, বৈঠকে গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থতার কারণ আইএমএফকে জানাবে এনবিআর। মন্থর প্রবৃদ্ধির জন্য আমদানি কমে যাওয়ায় শুল্ক বাবদ রাজস্ব আদায় কম হওয়াকে অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেবেন রাজস্ব কর্মকর্তারা।
পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরবেন এনবিআর কর্মকর্তারা। যার মধ্যে রয়েছে নতুন নতুন খাতে কর আরোপ, ইএফডি যন্ত্র বসানো, রাজস্ব আদায়ে অটোমেশন ইত্যাদি। এছাড়া আইএমএফকে জানানো হবে, এনবিআর আইএমএফ নির্দেশিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আশা করছে। তবে নিম্ন আমদানি ও সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে এসব খাত থেকে আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ আদায় কমতে পারে। চলতি বছরে আমদানিতে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় ভ্যাট আদায় অনেক কমেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাহত হবে রাজস্ব আদায়।
মোট ভ্যাট রাজস্বের প্রায় ১০ শতাংশ আদায় হয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও সংস্থার ক্রয় কার্যক্রম থেকে। চলতি বছর বিভিন্ন কোম্পানি ও সরকার কেনাকাটার বাজেট কমিয়েছে। ফলে এ খাত থেকে ভ্যাট আদায় আরও কমবে। এমন ধারণা থেকে চলতি অর্থবছরে প্রত্যাশিত ভ্যাট আদায় সম্ভব নাও হতে পারে বলে জানানো হবে আইএমএফকে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পূর্ণাঙ্গ তথ্য চায় আইএমএফ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আয়কর ও ভ্যাট বিভাগের দুই কর্মকর্তা বলেন, সরকারি ও বেসরকারি একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে এনবিআরের পাওনা হাজার কোটি টাকা। এই পাওনা আদায় করা সম্ভব হলে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চিন্তা করা লাগতো না। পেট্রোবাংলাসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আয়কর- ভ্যাটের বাকি টাকা উদ্ধারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
ভ্যাট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সিগারেটের ওপর কর পুনর্গঠন থেকে চলতি বছর বাড়তি ভ্যাট হিসেবে আদায় হবে ২ হাজার ৪শ কোটি টাকা। এছাড়া ইএফডি, মোবাইল ফোন, পলিপ্রোপিলিন স্ট্যাপল ফাইবার, সফটওয়্যার, এলপিজি সিলিন্ডারের ওপর শুল্ক ও কর সমন্বয়ের মাধ্যমে আরও ৪ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আইএমএফের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে রাজস্ব আদায় বাড়াতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে কিছু খাতের ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দিয়েছে ভ্যাট বিভাগ। এছাড়া নতুন কিছু খাতে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। বিষয়গুলো আইএমএফকে জানানো হবে।
আরও পড়ুন: মতামত না নিয়ে আইএমএফের অর্থ ব্যবহার করলে বৈষম্য বাড়বে
আয়কর বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের শর্ত পূরণে কাজ চলছে। এরই অংশ হিসেবে বাজেট অধিবেশনে পাস হয়েছে নতুন আয়কর আইন। যে আইনের আওতায় ভর্তুকি কমিয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। করের আওতায় আনা হয়েছে বেশকিছু নতুন খাত। আয়কর বিভাগের রিস্ক ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসেবে কর গোয়েন্দা ইউনিট চালুর বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন। পাশাপাশি আয়কর খাতে কমপ্লায়েন্স পূরণেও কাজ চলছে। আমদানি ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় শুল্ক আদায় কম হচ্ছে। তবে কাস্টমস বিভাগের ধারণা, শিগগির এ সমস্যা সমাধান হবে। আইএমএফকে আশার কথা শোনাতে পারবে কাস্টমস।
এসব বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আইএমএফের যেসব শর্ত সহজ ছিল, যেগুলো বিশেষ ঘোষণা দিয়ে কিংবা আদেশের মাধ্যমে করা সম্ভব, সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা ছিল সরকারের। তবে আর্থিক খাতে যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন ছিল, যেমন বিনিময় হার, কর আহরণ, সুদের হার- এসব কাঠামোগত ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি আমরা দেখতে পাইনি।
তিনি বলেন, সরকার খুবই একপেশেভাবে রিজার্ভ ধরে রাখতে গিয়ে অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলেছে। এর ফলে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। মানুষ এলসি খুলতে পারছে না। অন্যদিকে বিনিময় হার ঠিক না করার কারণে ব্যাংকের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক (কার্ব) বাজারে ডলারের দামে ৭-৮ টাকা পার্থক্য হয়ে গেছে। তবে আইএমএফের কারণে আমাদের আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা বেড়েছে।
এসএম/কেএসআর/জিকেএস