ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

সাধারণ বীমা করপোরেশনে বকেয়া দাবির পাহাড়

সাঈদ শিপন | প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

দেশে ব্যবসা করা বেসরকারি খাতের লাইফ ও নন-লাইফ বিমা কোম্পানিগুলো ২০২২-২৩ অর্থবছরে (২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) ৮৩ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেছে। বিপরীতে রাষ্ট্রয়ী মালিকানাধীন বিমা প্রতিষ্ঠানের দাবি পরিশোধের হার ৪৩ শতাংশ। এর মধ্যে জীবন বীমা করপোরেশনের দাবি পরিশোধের হার ৮৯ শতাংশ ও সাধারণ বিমা করপোরেশনের মাত্র ১৯ শতাংশ।

দাবি পরিশোধ নিয়ে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তৈরি করা প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি এই প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়েছে আইডিআরএ।

ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, উদ্বৃত্ত ও নতুন দাবি মিলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সাধারণ বিমা করপোরেশনে মোট দাবি উত্থাপিত হয় ১ হাজার ১১৫ কোটি ২১ লাখ ৯৮ হাজার ৯৯৮ টাকা। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ২০৯ কোটি ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার ২৯০ টাকা পরিশোধ করেছে। অর্থাৎ, দাবি পরিশোধের হার মাত্র ১৯ শতাংশ।

দাবি পরিশোধের হার এত কম হওয়ার কারণ হিসেবে কোম্পানিটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, সাধারণ বীমা করপোরেশন বেশকিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দাবির টাকা পরিশোধ করে। এরপরও ঠিকমতো কাগজপত্র পাওয়া গেলে দ্রুত দাবি পরিশোধ করা হয়। সঠিকভাবে কাগজপত্র পাওয়া গেছে এমন দাবি পরিশোধের হার ৯০ শতাংশের ওপরে। কিন্তু অনেক সময় সঠিকভাবে কাগজপত্র পাওয়া যায় না, এ কারণে সার্বিক দাবি পরিশোধের হার কম।

আরও পড়ুন>> বন্ধ হতে পারে এক ডজন বিমা কোম্পানির ব্যবসা

বিমা দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। দাবি পরিশোধের হার বাড়ছে। কয়েকটি বিমা কোম্পানিতে সমস্যা থাকার পরও বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধের হার ৯১ শতাংশ। এটা সন্তোষজনক। তবে আমি মনে করি বিমা দাবি শতভাগ পরিশোধ হওয়া উচিত।

এদিকে রাষ্ট্রয়ী মালিকাধীন আরেক প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা করপোরেশন গ্রাহকদের ৫৮৫ কোটি ৫ লাখ ১৬ হাজার ৭৭৯ টাকা দাবির বিপরীতে ৫১৯ কোটি ৯৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। এই কোম্পানিটির দাবি পরিশোধের হার ৮৯ শতাংশ।

রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন দুই প্রতিষ্ঠানে মোট দাবি উত্থাপিত হয় ১ হাজার ৭০০ কোটি ২৭ লাখ ১৫ হাজার ৭৭৭ টাকা। বিপরীতে দাবি পরিশোধ করা হয়েছে ৭২৯ কোটি ৮৯ লাখ ৩৩ হাজার ২৯০ টাকা। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন দুই প্রতিষ্ঠানে ৯৭০ কোটি ৩৭ লাখ ৮২ হাজার ৪৮৭ টাকা বা ৫৭ শতাংশ দাবি বকেয়া পড়ে রয়েছে।

বায়রা লাইফ ও ফারইস্ট ইসলামী লাইফ বাদ দিয়ে বাকি বেসরকারি লাইফ ও নন-লাইফ বিমা কোম্পানিগুলোতে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি ৫১ লাখ ৩৪ হাজার ২৯৭ টাকা বিমা দাবি বকেয়া রয়েছে। এ হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোতে মোট বিমা দাবি বকেয়া পড়েছে ২ হাজার ৬৫৩ কোটি ৮৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৮৪ টাকা। অর্থাৎ, বকেয়া বিমা দাবির প্রায় অর্ধেক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুই বিমা প্রতিষ্ঠানের।

সাধারণ বিমা করপোরেশন সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি একটা বিধি-বিধান আছে, কমিটি আছে ওনাদের মতামত নিতে হয়। জিএমদের আর্থিক ক্ষমতা আছে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়ার। এর বেশি হলে এমডির কাছে যায়। এমডির আর্থিক ক্ষমতা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের ৮ হাজার ৯৭৫ কোটি ৮০ লাখ ৮৪ হাজার ২২১ টাকার দাবি পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে বেসরকারি লাইফ বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের ৮ হাজার ৬৪ কোটি ৩১ লাখ ৮ হাজার ৫৯১ টাকা দাবির বিপরীতে ৭ হাজার ৩৪৯ কোটি ৪৫ লাখ ৬৪ হাজার ৫২১ টাকা পরিশোধ করেছে। দাবি পরিশোধের হার ৯১ শতাংশ।

আরও পড়ুন>> আইন লঙ্ঘন করে হচ্ছে সরকারি সম্পত্তির বিমা

অপরদিকে নন-লাইফ বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের ১ হাজার ৮৬৫ কোটি ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৩৬ টাকা দাবির বিপরীতে পরিশোধ করেছে ৮৯৬ কোটি ৪৫ লাখ ৮৬ হাজার ৪১০ টাকা। দাবি পরিশোধের হার ৪৮ শতাংশ।

অর্থাৎ, জীবন বিমা কোম্পানিগুলো যে হারে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ করেছে, সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলো সেই হারে দাবি পরিশোধ করতে পারেনি। আবার প্রতিবেদনে বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধের হার ৯১ শতাংশ দেখা গেলেও সঠিক কি না তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র দায়িত্বশীলরাও দাবি পরিশোধের এ হারের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

এ বিষয়ে আইডিআরএ’র মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানিগুলো যে তথ্য দিয়েছে, তাতে দাবি পরিশোধের হার ৯১ শতাংশ। কিন্তু আমাদের কাছে গ্রাহকদের দাবির টাকা না পাওয়ার ব্যাপক অভিযোগ আছে। সুতরাং ,এ তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমরা বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখবো।

জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর তুলনায় সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধের হার কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোম্পানিগুলো যাতে সঠিকভাবে গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধ করে, কর্তৃপক্ষ সে জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। জীবন বিমার তুলনায় সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধের হার কম হওয়ার বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা হবে এবং গ্রাহকরা যাতে দাবির টাকা পান সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

সাধারণ বীমা করপোরেশনে দাবি পরিশোধের হার মাত্র ১৯ শতাংশ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির দাবি বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) এস এম শাহ্ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণ বিমা করপোরেশন সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি একটা বিধি-বিধান আছে, কমিটি আছে ওনাদের মতামত নিতে হয়। জিএমদের আর্থিক ক্ষমতা আছে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়ার। এর বেশি হলে এমডির কাছে যায়। এমডির আর্থিক ক্ষমতা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত।’

আরও পড়ুন>> টিকে থাকার লড়াইয়ে বেশিরভাগ নতুন জীবন বিমা কোম্পানি

‘এর বেশি হলে বোর্ডে যায়, কমিটিতে যায়। আমাদের হয়তো মাসে একটা বোর্ড মিটিং হয়, সর্বোচ্চ দুটি হয়। কাজেই মিটিংয়ে কোনো কোয়ারি থাকলে, সেই কোয়ারি ফ্ল্যাপ করে আবার একটা বোর্ড মিটিংয়ে যায়। তারপরও আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে সর্বনিম্ন সময়ে দাবি পরিশোধ করার’ বলেন শাহ আলম।

তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হয়। কাগজপত্র না পেলে তো দাবি পরিশোধ করা যায় না। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীও দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে সঠিকতা যাচাই করতে বলেছেন। কোনো দাবি যেন যথার্থতার বাইরে না দেওয়া হয়। এটাও দেখতে হয় আমাদের। এ কারণে দাবি পরিশোধে একটু বেশি সময় লাগে। তবে কাগজপত্র পাওয়ার পর আমাদের দাবি পরিশোধের হার ৯০ শতাংশের ওপরে। আমাদের দাবি বকেয়া থাকার মূল কারণ সঠিকভাবে কাগজ না পাওয়া।’

বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর তুলনায়, সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোতে দাবি পরিশোধের হার কম হওয়ার কারণ হিসেবে মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, জীবন বিমা কোম্পানির দাবি পরিশোধের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষের তেমন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের বড় ভূমিকা রয়েছে। সাধারণ বিমা কোম্পানিতে কোনো দাবি উত্থাপিত হলে, সেই দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে সার্ভে রিপোর্ট লাগে। আবার আগুনের ঘটনা হলে ফায়ারের রিপোর্ট লাগে। আবার রি-ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে রি-ইন্স্যুরেন্স করা কোম্পানির অনুমোদন লাগে। অনেকগুলো প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কারণে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধের হার কিছুটা কম।

সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের সভাপতি ও পপুলার লাইফের সিইও বি এম ইউসুফ আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিমা দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। দাবি পরিশোধের হার বাড়ছে। কয়েকটি বিমা কোম্পানিতে সমস্যা থাকার পরও বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধের হার ৯১ শতাংশ। এটা সন্তোষজনক। তবে আমি মনে করি বিমা দাবি শতভাগ পরিশোধ হওয়া উচিত।’

এমএএস/এএসএ/জেআইএম