ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

পণ্য প্যাকেজিংয়ে মাত্রাতিরিক্ত খরচ, বিপাকে ব্র্যান্ডগুলো

নাজমুল হুসাইন | প্রকাশিত: ১২:০৪ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

যে কোনো ব্র্যান্ডের পণ্যের জন্য প্যাকেজিং বা মোড়কজাতকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভালোমানের প্যাকেজিং ক্রেতার কাছে তৈরি করে ব্র্যান্ডভ্যালু। বিশ্ববাজারে ক্রমাগত কাঁচামালের দাম বাড়ায় বাড়ছে প্যাকেজিং খরচ। ডলারের দামও তৈরি করছে বাড়তি চাপ। ব্র্যান্ডগুলো প্যাকেজিংয়ের মান ধরে রাখতে রীতিমতো হিমশিম। এ বাড়তি খরচের চাপ পরোক্ষভাবে ভোগ করছে ভোক্তাও।

পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ২০২১ সালের পর থেকে তাদের পণ্য প্যাকিং খরচ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে, যা ওই সময়ের তুলনায় এখন ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। খরচের এ খড়্গ পরোক্ষভাবে ভোক্তাকে বহন করতে হলেও অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানিকেও নিতে হচ্ছে এ ভার। কারণ পণ্যের দামের সঙ্গে খরচ সমন্বয় করতে গিয়ে অনেক ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রি কমেছে। অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও কমছে।

আরও পড়ুন>> ১০ শ্রেণির পণ্যে এলসি মার্জিনের শর্ত শিথিল

এ পরিস্থিতিতে পণ্য প্যাকেজিং-প্রিন্টিং খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাকালীন তাদের খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ওই সময় থেকে আমদানি কাঁচামালের দামও বাড়তে শুরু করে বিশ্ববাজারে, যা এক বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এরপর করোনা পরবর্তীসময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাঁচামালের বাজার সেই স্বস্তির জায়গায় আর ফেরেনি। দাম কিছুটা কমলেও এখনো প্যাকেজিং খাতের প্রায় সব কাঁচামালের মূল্য অস্বাভাবিক রয়ে গেছে। করোনার আগের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় সেটা সর্বোচ্চ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। এর মধ্যে ২০২২ সালের বাজেটে আমদানি করা পেপার, পেপার বোর্ড, আর্ট কার্ড ও আর্ট পেপারের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। পাশাপাশি মুদ্রণশিল্পের অন্যতম কাঁচামাল প্রিন্টিং প্লেটের আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ১০ শতাংশ। মুদ্রণ কালির আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। বাড়তি কর ও শুল্কের কারণেও দেশের প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং খাতে অস্থিরতা চলছে।

আরও পড়ুন>> সরকারি সহযোগিতা চান প্যাকেজিং-প্রিন্টিং-পাবলিকেশন ব্যবসায়ীরা

এ পরিস্থিতিতে নিজেদের পণ্যের প্যাকিং খরচ আগের চেয়ে ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে বলে জানিয়েছে খাদ্য প্রস্তুতকারী ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বনফুল অ্যান্ড কিষোয়ান গ্রুপ। এ গ্রুপের পণ্য প্রায় শতভাগ প্যাকেজিং হয়। গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক শাহ্ কামাল মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, ২০২১ সালের পর থেকে দ্রুত পণ্য প্যাকেজিংয়ের খরচ বেড়েছে। যেটা সমন্বয় করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা বেশি ব্যবহার করি ফয়েল প্যাক। আগে এসব প্যাকেট আমরা প্রিন্টিংসহ প্রতি কেজি ৩১০ থেকে ৩২০ টাকার মধ্যে নিতে পারতাম, যা এখন ৪৫০ থেকে ৪৬০ টাকায় নিচ্ছি। এছাড়া নিজেদের কারখানায় প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে খরচও বেড়েছে। কর্মীদের বেতন, সেবাখাতের খরচ, পরিবহনসহ সবকিছু বেড়েছে।

এ বিষয়ে কিষোয়ান গ্রুপের পরিচালক ও বনফুল অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের নির্বাহী পার্টনার ওয়াহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের পণ্য ৩৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। যে কারণে অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে আমাদের। প্যাকেজিং খরচ সমন্বয় করতে গেলে রপ্তানিতে পিছিয়ে যাচ্ছি। শুধু আমরা নয়, গত দুই বছর দেশে সার্বিক খাদ্যপণ্য রপ্তানিও কমার একটি বড় কারণ এ পাকেজিংয়ের বাড়তি খরচ।

এ বিষয়ে কথা হয় দেশের বৃহত্তম নিত্যব্যবহার্য ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটির করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশনস বিভাগের পরিচালক শামিমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, গত বছর আমাদের প্রোডাক্টের দাম বাড়ানো হয়েছিল, যার একটি বড় কারণ ছিল প্যাকেজিংয়ের খরচ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। ওই সময় প্লাস্টিক ম্যাটেরিয়ালের দাম প্রচুর বেড়ে যায়, যা আমাদের প্যাকেজিংয়ের মেইন ইনগ্রিডিয়েন্ট (মূল উপাদান) ছিল। এতে আমাদের প্রতিটি প্যাকেজিং অনুষঙ্গ সরবরাহকারীদের পেমেন্ট রিভিশন করতে হয়েছে।

আরও পড়ুন>> সবজি-ফল রফতানি বাড়াতে হচ্ছে রোডম্যাপ

দেশের প্যাকেজিং শিল্পে বেশ কিছু ব্যবসায়ী সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে ক্রেতা-ভোক্তাদের খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য ভোগ্যপণ্য পাকেজিং শিল্পের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্লেক্সিবল প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন। এ সংগঠনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্যাকেজিং শিল্পের সামগ্রিক বাজার প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার। প্যাকেজিং পণ্যের বার্ষিক চাহিদা দুই লাখ টন। যার প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ আমদানিনির্ভর। বাকি চাহিদা মেটাচ্ছে দেশি প্রতিষ্ঠান।

সংগঠনের সভাপতি সাফিউস সামি আলমগীর বলেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে দেশে ডলারের উচ্চ বিনিময় হারের কারণে এ খাতের ব্যবসায়ীদের এলসি খোলা কমে গেছে। কাঁচামাল আসা কমেছে। এলসি খোলায় ডলার সংকটও ছিল বেশ কিছু সময়। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে প্যাকেজিং শিল্প বেশ কয়েক বছর ধরে খারাপ সময় পার করছে। এ পরিস্থিতিতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ আমরা দিতে পারছি না। পণ্য উৎপাদনকারীরা বাড়তি চাপে পড়েছেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে এ খাতের প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে। অথচ ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এ শিল্পের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে। এমনকি করোনা মহামারির আগের দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এ শিল্পের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২০ শতাংশ। এখন অর্ধেকেরও কম হচ্ছে।

দেশে বাণিজ্যিকভাবে প্যাকেজিং শিল্প ১৯৭৮ সালে সাফিউস সামি আলমগীরের ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের হাত ধরে শুরু করেছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০০টিরও বেশি প্যাকেজিং কারখানা আছে। এ খাতে এখন আকিজ গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করছে। একেকটি মাঝারি আকারের প্যাকেজিং ফ্যাক্টরি স্থাপনে একশো কোটি টাকা ব্যয় হয়। বড় বড় শিল্পগ্রুপ এ খাতে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

এসব উদ্যোক্তা এটাও বলছেন, এ খাতে কিছু অসামাঞ্জস্য রয়েছে। কিছু আমদানিকারক বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধার আওতায় প্যাকেজিংয়ের কাঁচামাল নিয়ে আসছেন, যা স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। যদিও সেগুলো কেবল রপ্তানিমুখী পণ্যে ব্যবহারের জন্য। এতে তারা পিছিয়ে পড়ছেন।

অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসা পর্যন্ত প্যাকেজিং শিল্পের সংকট কাটিয়ে আগের জায়গায় ফেরার সম্ভাবনা দেখছেন না প্যাকেজিং-প্রিন্টিং খাতের ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রিন্টিং, প্যাকেজিং অ্যান্ড পাবলিকেশনস বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সচিব আমিন বলেন, বিশ্বব্যাপী প্যাকেজিং, প্রিন্টিং ও প্রকাশনা খাতের সম্মিলিত বাজার প্রায় এক হাজার ৫৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর এক শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা গেলেও সম্ভাব্য রপ্তানির পরিমাণ হবে ১৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ সহায়তার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে এখানে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেজিংয়ের ব্যবহার বাড়ছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। উন্নত দেশগুলোতে প্রায় ৮০ শতাংশ খাদ্যই প্রক্রিয়াজাত। দেশেও এর পরিমাণ ২০ শতাংশের কাছাকাছি। বিপুল সম্ভাবনার এ বাজার সম্প্রসারণে সরকারি সহায়তার পাশাপাশি রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, শিল্প-কারখানার কমপ্লায়ান্সসহ আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং পণ্য তৈরি করতে হবে।

এনএইচ/এএসএ/এএসএম