ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

ডিজিটাল হুন্ডি-জুয়ায় পাচার হচ্ছে টাকা, এমএফএস লেনদেনে নজরদারি

ইয়াসির আরাফাত রিপন | প্রকাশিত: ১২:৩৪ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০২৩

দিন যত গড়াচ্ছে দেশের সব শ্রেণির জনগণের কাছে ততই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম। তুলনামূলক সাশ্রয়ী চার্জ, খুবই দ্রুত, সুরক্ষিত এবং নিরাপদ পেমেন্ট হওয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডিজিটাল মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন। তবে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম কাজে লাগিয়ে দেশ থেকে অর্থপাচারের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে ‘ডিজিটাল হুন্ডি’। সুরক্ষিত মোবাইল অ্যাপে যোগাযোগ এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবা (এমএফএস) ব্যবহার করে বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠানো হচ্ছে। প্রবাসীর স্বজনরা টাকাও পাচ্ছেন, ফলে প্রক্রিয়াটি বৈধ নাকি অবৈধ- তা নিয়ে তারা ভাবছেন না। তবে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। হুন্ডি কারবারিদের কারসাজিতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বাংলাদেশ।

অবৈধ হুন্ডির সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেক্স ও ক্রিপ্টো ট্রেডিং। ফলে একদিকে মুদ্রা পাচার বাড়ছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এসব অবৈধ কার্যকলাপ রোধে একসঙ্গে কাজ করছে সরকারের বেশ কিছু সংস্থা। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার লেনদেনে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন হওয়া অ্যাকাউন্ট ফ্রিজসহ (জব্দ) ডিজিটাল হুন্ডি কারবারিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।

 

হুন্ডির মাধ্যমে এক বছরে পাচার হয়েছে ৭৮০ কোটি ডলার বা ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই সময় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হুন্ডি কারবারে জড়িত ১৬ জনকে গ্রেফতারের কথাও জানায় সিআইডি।

 

আরও পড়ুন: অনলাইন জুয়ায় বুঁদ রিকশাচালক-দিনমজুররাও 

দেশে অর্থপাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। ডিজিটাল হুন্ডি লেনদেনে জড়িত সন্দেহে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা (এমএফএস) এজেন্ট বাতিলসহ অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে নানা তথ্য সরবরাহ করছে বিএফআইইউ। পাশাপাশি সহযোগিতা করছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোও। সবার মিলিত প্রয়াসে অর্থপাচার রোধে দিনে গড়ে ২০০ এমএফএস হিসাব জব্দ করা হচ্ছে।

অর্থপাচার ও হুন্ডি তৎপরতা বন্ধ তথা অবৈধপথে রেমিট্যান্স গ্রহণ নিরুৎসাহিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করা হচ্ছে প্রবাসীদের। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ফেসবুক পেজে চালানো হচ্ছে এ সংক্রান্ত প্রচারণা। আবার বিদেশে অবৈধভাবে বিভিন্ন এমএফএস প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহার করে যাতে হুন্ডি না হয়, এ বিষয়ে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: ভোগান্তি এড়াতে হুন্ডিতে ঝুঁকছেন প্রবাসীরা 

গত বছরের (২০২২) সেপ্টেম্বরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানায়, হুন্ডির মাধ্যমে এক বছরে পাচার হয়েছে ৭৮০ কোটি ডলার বা ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এ সময় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হুন্ডি কারবারে জড়িত ১৬ জনকে গ্রেফতারের কথাও জানায় সিআইডি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বৈধপথে রেমিট্যান্স আনার ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করছি। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানো নিরাপদ, পাশাপাশি পাওয়া যায় অতিরিক্ত আড়াই শতাংশ প্রণোদনা। হুন্ডি ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ। তবুও যারা অর্থপাচার বা হুন্ডি, গ্যাম্বলিং, ক্রিপ্টো ট্রেডিংয়ে জড়িত- তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে আমরা বিএফআইইউকে বলেছি। তারা এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে।’

আরও পড়ুন: অর্থ ডিজিটাল রূপান্তরে বাড়বে রেমিট্যান্স, কমবে হুন্ডি 

অর্থপাচার রোধে কাজ করা একটি সংস্থার সূত্র জানায়, হুন্ডিতে জড়িত সন্দেহে কুমিল্লা ও ফেনী এলাকার ছয় এমএফএস ডিস্ট্রিবিউটরের তথ্য সিআইডির হাতে। এরই মধ্যে বন্ধ করা হয়েছে দুই ডিস্ট্রিবিউটরের কার্যক্রম। পাশাপাশি হুন্ডি লেনদেনে জড়িত সন্দেহে ৪ হাজার ৮৫৩টি এমএফএস এজেন্ট বাতিল করা হয়েছে। এ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত অভিযোগে ৫ হাজার ৭৬৬ জন এজেন্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সুপারিশ রয়েছে সিআইডিতে। হুন্ডির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে ২১টি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান ও এদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৩৯টি হিসাবের তথ্যও সিআইডিতে। একই সঙ্গে হুন্ডি প্রতিরোধে ২২৯টি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এএমএল বা সিএফটি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

 

হুন্ডি লেনদেনে জড়িত সন্দেহে ৪ হাজার ৮৫৩টি এমএফএস এজেন্ট বাতিল করা হয়েছে। এ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত অভিযোগে ৫ হাজার ৭৬৬ জন এজেন্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সুপারিশ রয়েছে সিআইডিতে।

 

ডিজিটাল হুন্ডি বা অর্থপাচার প্রতিরোধে সক্রিয় রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) কোম্পানিগুলোও। কোনো সন্দেহজনক লেনদেন পেলে নিজেরাই সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। পরে বিএফআইইউয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ঠিক করছে করণীয়।

আরও পড়ুন: হুন্ডি-গ্যাম্বলিং-ক্রিপ্টো ট্রেডিং প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি 

এ বিষয়ে কথা হয় মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘রাত ২টার পর কেউ একাধিক দিন লেনদেন করলে আমরা সেটা যাচাই-বাছাই করি। এটা দু-একদিন হতে পারে, তাই বলে প্রতিদিন একই সময়ে লেনদেন হলে সেটা অস্বাভাবিক। এ বিষয়ে আমরা পর্যবেক্ষণ করি। আবার কোনো একটা হিসাব থেকে শুধু সেন্ড মানি হচ্ছে, আরও মাধ্যমগুলো (পেমেন্ট, পে-বিল, রিচার্জসহ অন্যান্য সুবিধা) ব্যবহার হচ্ছে না, তাহলে সেখানেও সন্দেহের বিষয় থাকে। তবে আমাদের কোম্পানির ক্ষেত্রে এমনটা নেই। সম্প্রতি চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিন শতাধিক সিম বন্ধ করা হয়েছে বিভিন্ন অপরাধে। সেখানেও আমরা ছিলাম না। তবে দেশের স্বার্থে অর্থপাচার রোধে এগিয়ে আসতে হবে।’

বিএফআইইউয়ের একটি সূত্র জানায়, হুন্ডি সংশ্লিষ্ট নগদ লেনদেন ও সন্দেহজনক লেনদেন সম্পর্কিত তথ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল হুন্ডির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লেনদেন সহজে শনাক্ত করতে ইন্ডিকেটর প্রস্তুত করে সেগুলো সরবরাহ করা হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এসব ইন্ডিকেটরের আওতায় এমএফএস প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অনলাইন জুয়া বা হুন্ডির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ২০ হাজার ৭২৫টি ব্যক্তিগত হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।

অবৈধ হুন্ডি, গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টো ট্রেডিং সংক্রান্ত বিষয়ে এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে মোট ৮১৪টি ওয়েবসাইট, ১৫৯টি অ্যাপ, ৩৩৭টি ফেসবুক পেজ, দুটি ইনস্টাগ্রাম পেজ এবং ১০৩টি ইউটিউব লিংক। এগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এ সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করেছে বিএফআইইউ।

আরও পড়ুন: অনলাইন জুয়া ‘শিলং তীর’, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা যাচ্ছে ভারতে 

আর্থিক খাতের এ গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং বা পেমেন্টের সুবিধা কাজে লাগিয়ে সহজেই বিস্তার লাভ করেছে বিভিন্ন আর্থিক অপরাধ। এর মধ্যে অবৈধ অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেক্স এবং ক্রিপ্টো ট্রেডিং অন্যতম। সম্প্রতি এসব অপরাধের মাধ্যমে হওয়া অবৈধ লেনদেন মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে এসব অপরাধ হুন্ডি প্রক্রিয়াকে সহজ ও ত্বরান্বিত করছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে মুদ্রাপাচার। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে দেশ।

বিএফআইইউয়ের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ এখন। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের কার্যক্রম। আর্থিক খাতে বাড়ছে ডিজিটাল পেমেন্ট ও স্মার্ট পেমেন্টের প্রয়োগ। যার সুফল পাচ্ছে দেশ। সুফল ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে এসব ব্যাংকিং ও পেমেন্ট সিস্টেমের অপব্যবহার। তবে হুন্ডি, অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেন্স এবং ক্রিপ্টো ট্রেডিং প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতিতে সরকার। বিএফআইইউ এ বিষয়ে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে।

আরও পড়ুন: বাড়ছে অনলাইন জুয়ায় আসক্তি, খোয়া যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা 

সম্প্রতি অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেন্স এবং ক্রিপ্টো ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার রোধে জরুরি সভা করেছে বিএফআইইউ। এতে অংশ নেন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিটিআরসি), বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রান্সন্যাশনাল অ্যান্ড সাইবার ক্রাইম বিভাগ এবং গোয়েন্দা ও প্রাইভেট খাতের প্রতিনিধিরা।

 

রাত ২টার পর কেউ একাধিক দিন লেনদেন করলে আমরা সেটা যাচাই-বাছাই করি। এটা দু-একদিন হতে পারে, তাই বলে প্রতিদিন একই সময়ে লেনদেন হলে সেটা অস্বাভাবিক। এ বিষয়ে আমরা পর্যবেক্ষণ করি।

 

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের তদন্ত শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার বাছির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএফআইইউ থেকে অনেক তথ্য এসেছে। আমরা এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি। সেগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। সত্যতা পেলে মামলা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

বিএফআইইউ প্রধান কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবৈধ হুন্ডি, অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেক্স এবং ক্রিপ্টো ট্রেডিংয়ের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে মুদ্রা পাচার হয়। একই সঙ্গে এসব ব্যবহারে সামাজিক অবক্ষয় ও যুবসমাজ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। এজন্য আমরা অবৈধ লেনদেনে জড়িত থাকে এমন ২০০ হিসাব প্রতিদিন ফ্রিজ করছি।’

ইএআর/কেএসআর/জিকেএস