‘অনিয়মে নিমজ্জিত’ ট্রাস্ট লাইফ ছুটছেই
বিমা ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা অনিয়মে জড়ালেও শেয়ারবাজারে দাপট দেখিয়ে চলেছে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। গত সপ্তাহে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসের প্রতি কার্যদিবসেই কোম্পানিটির শেয়ার দাম বাড়ার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করে। ফলে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) দাম বাড়ার শীর্ষ স্থানটি দখল করেছে এই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার।
শুধু গত সপ্তাহে নয় শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই দাম বাড়ার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করেছে এই জীবন বিমা কোম্পানিটি। শেয়ারবাজারের নিয়ম অনুযায়ী, একদিনে কোম্পানিটির শেয়ার দাম সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়তে পারে। গত ১১ মে থেকে শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরুর পর এখন পর্যন্ত প্রতিটি কার্যদিবসেই দিনের সর্বোচ্চ দামে কোম্পানিটির শেয়ারের বিপুল ক্রয় আদেশ এসেছে। অপরদিকে প্রতিদিনই শূন্য পড়ে থেকেছে বিক্রয় আদেশের ঘর।
এভাবে দাম বাড়ায় এক মাসের কম সময়ের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ৬২০ শতাংশ। এতে ১০ টাকা দামের প্রতিটি শেয়ারের দাম ৭২ টাকায় উঠে গেছে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী কোম্পানিটির মাত্র ৩৭টি করে শেয়ার পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: ট্রাস্ট লাইফের সীমাহীন ব্যয়, হুমকিতে গ্রাহকের টাকা
গেল সপ্তাহে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসের প্রতি কার্যদিবসেই ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের শেয়ার দাম বাড়ার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করায়, এক সপ্তাহেই কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ৬০ দশমিক ৩৬ শতাংশ। টাকার অঙ্কে বেড়েছে ২৭ টাকা ১০ পয়সা। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৭২ টাকা, যা আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৪৪ টাকা ৯০ পয়সা।
সরকারি ট্রেজারি বন্ড, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, এফডিআর বিনিয়োগ এবং ইস্যু ব্যবস্থাপনা খাতে খরচ করতে আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে ১৬ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে ট্রাস্ট লাইফ। এ জন্য আইপিওতে কোম্পানিটি ১০ টাকা করে ১ কোটি ৬০ লাখ শেয়ার ইস্যু করে।
এদিকে শেয়ারের দাম বাড়ার পরও বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করতে চাননি। ফলে সপ্তাহজুড়ে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। আর প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৬২ লাখ ২৩ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন: ট্রাস্ট লাইফে ঝুঁকিতে গ্রাহকের টাকা
শেয়ারের এমন দাম বাড়লেও বিমা ব্যবসায় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, আইন লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর ধরে বিমা গ্রাহকদের টাকা অবৈধভাবে খরচ করছে নতুন প্রজন্মের এই জীবন বিমা কোম্পানিটি। সেই সঙ্গে প্রতি বছর কোম্পানিটি যে নতুন বিমা পলিসি বিক্রি করছে, তার সিংহভাগ তামাদি হয়ে যাচ্ছে। এতে দুর্বল হয়ে পড়ছে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা।
ফলে ভবিষ্যতে এই জীবন বিমা কোম্পানিটি গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সম্প্রতি এক তদন্ত করে এমন অভিমত দিয়েছে আইডিআরএ’র তদন্ত দল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই তদন্ত করে আইডিআরএ।
ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের বিষয়ে তদন্ত দল যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে সেখানে, ট্রাস্ট লাইফের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চ হার, দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন কম হওয়া, কোম্পানির নগদ আন্তঃপ্রবাহ কম থাকাসহ বেশ কিছু অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন: চার সপ্তাহ পর পতনে শেয়ারবাজার
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ প্রতিবছর যে প্রিমিয়াম আয় করছে, তার প্রায় পুরোটাই ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির পাঁচ বছরের আর্থিক চিত্র পর্যালোচনা করেছে তদন্ত কমিটি। এই পাঁচ বছরে কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ব্যয় করেছে ২৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
আইডিআরএ’র তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, প্রতিবছর কোম্পানিটির সিংহভাগ পলিসি তামাদি বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে কোম্পানিটির মোট বিমা পলিসি ছিল ১১ হাজার ৮১১টি। বছরটিতে পলিসি তামাদি হয় ৭ হাজার ৭৪৩টি। এতে সচল পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৮টি। বছরটিতে তামাদি পলিসির হার ৬৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
আগের বছর ২০২০ সালে তামাদি পলিসির হার ছিল ৮২ দশমিক ২১ শতাংশ। বছরটিতে মোট বিমা পলিসি ছিল ১২ হাজার ৭২২টি। এরমধ্যে ১০ হাজার ৪৫৯টি পলিসি তামাদি হয়ে যায়। ফলে সচল পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ২৬৩টি। ২০১৯ সালে পলিসি তামাদির হার ছিল ৮৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। বছরটিতে মোট বিমা পলিসি ছিল ১০ হাজার ৮২টি। এরমধ্যে ৮ হাজার ৫৮৫টি তামাদি হয়ে যায়। ফলে চলমান পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৯৭টি।
একইভাবে ২০১৮ সালে কোম্পানিটিতে তামাদি পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ১৭৭টি। এ বছর মোট বিমা পলিসি ছিল ১০ হাজার ৬৭টি। ফলে বছর শেষে সচল পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৮৯০টি। আর তামাদি পলিসির হার দাঁড়ায় ৭১ দশমিক ২৯ শতাংশ। ২০১৭ সালে পলিসি তামাদির হার ছিল ৭৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বছরটিতে ৯ হাজার ১৪৫টি বিমা পলিসির বিপরীতে তামাদির পলিসি দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৬টি। এতে সচল পলিসি থাকে ২ হাজার ৫৯টি।
এভাবে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ পলিসি তামাদি হয়ে যাওয়ায় কোম্পানিটি নবায়ন প্রিমিয়াম আয়েও ধস নেমেছে। প্রতি বছর কোম্পানিটি নতুন বিমা পলিসি বিক্রি করে যে প্রিমিয়াম আয় করছে, পরের বছরের তার সিংহভাগ আদায় হচ্ছে না। ২০২১ সালে কোম্পানিটির দ্বিতীয় বর্ষ নবায়নের শতকরা হার দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০২০ সালে দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ের হার ছিল ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। তার আগে ২০১৯ সালে ২১ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ২৫ দশমিক ৮২ শতাংশ আদায় হয়। অর্থাৎ প্রতি বছর কোম্পানিটি নতুন যে পলিসি বিক্রি করছে, পরের বছরেই তার ৭০ শতাংশের বেশি আর আদায় হচ্ছে না।
ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের আর্থিক চিত্র পর্যালোচনা করে আইডিআরএ’র তদন্ত দল অভিমত দিয়েছে, দ্বিতীয় বর্ষ প্রিমিয়াম নবায়ন হার, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদি হওয়ার হার এবং প্রিমিয়াম সংগ্রহের ব্যয় কোম্পানির আর্থিক ভিত্তিকে দুর্বল করে রেখেছে। কোম্পানির নগদ আন্তঃপ্রবাহ কম থাকায় ভবিষ্যতে ট্রাস্ট লাইফ গ্রাহকদের উত্থাপিত বিমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে।
এদিকে গত সপ্তাহে দাম বাড়ার শীর্ষ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। গত সপ্তাহজুড়ে এই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর পরের স্থানটিতে রয়েছে এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। সপ্তাহজুড়ে এ কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ২০ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
এছাড়া দাম বাড়ার শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকা প্রোগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২০ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ইয়াকিন পলিমারের ১৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ, জিকিউ বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজের ১৭ দশমিক ২২ শতাংশ, ফাইন ফুডসের ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১৪ দশমিক ৮১ শতাংশ, বঙ্গজ ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১২ দশমিক ৯৭ শতাংশ দাম বেড়েছে।
এমএএস/জেডএইচ/এএসএম