ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

নতুন আয়কর আইন

বিদেশে স্থায়ী হতেও লাগবে কর সনদ, তল্লাশি-জব্দে অসীম ক্ষমতা

সাইফুল হক মিঠু | প্রকাশিত: ০৯:০০ এএম, ১০ জুন ২০২৩

#আয়কর নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না
#তল্লাশি-জব্দে কর্মকর্তাদের অসীম ক্ষমতা
#কর আদায়ে বাধা দিলে জরিমানা ৫০ লাখ
#বাড়ছে জরিমানা, টিআইএন বাতিলের সুযোগ

বিদেশে স্থায়ী হওয়ার কথা ভাবছেন? দেশ ছাড়ার আগেই আপনাকে নিতে হবে কর পরিশোধের সনদ। ছুটতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ক্ষমতাপ্রাপ্ত উপ-কর কমিশনারের দপ্তরে। সনদ না পেলে কোনোভাবেই দেশ ছাড়া যাবে না। কেউ প্রবাসে স্থায়ী হলে তাকে আগের অর্থবছর ও চলতি অর্থবছরের কর জমা দিয়ে যেতে হবে। আবার বিদেশ ভ্রমণ বা জরুরি কাজে দেশের বাইরে গেলে তখন লাগবে ‘অব্যাহতি সনদ’। ‘আয়কর আইন ২০২৩’-এর খসড়ায় এমন বিধান রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৮ জুন) আইনটি পাসের জন্য বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। চলতি অধিবেশনেই এটি সংসদে পাস হতে পারে।

গত বছরের শেষের দিকে আয়কর আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে সব মিলিয়ে ২৫টি অধ্যায় রয়েছে। এর ধারা ৩৪৫টি ও তফসিল আটটি। আইনটি বাংলা ভাষায় প্রণীত। বৃহস্পতিবার (৮ জুন) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘আয়কর বিল ২০২৩’ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। এরপর বিলটি পাঁচদিনের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

বিদ্যমান ‘আয়কর অধ্যাদেশে’ কিছু পরিবর্তন এনে নতুন আয়কর আইন প্রণীত হয়েছে। এতে কোম্পানির সংজ্ঞা পরিবর্তন, কোম্পানিকে প্রতি মাসে উৎসে করের রিটার্ন দাখিল, রিটার্নের প্রমাণ দাখিলে বাধ্যবাধকতায় আরও পাঁচ খাত যুক্ত, বিদেশে ঘুরতে গেলে সম্পদের তথ্য দেওয়া ইত্যাদি। টিআইএন বাতিলের সুযোগ রাখা হয়েছে। বাড়িভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসায় সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছে। সংসদে পাসের জন্য উত্থাপন করা ‘আয়কর আইন ২০২৩’-এ নতুন যুক্ত করা কিছু বিধান তুলে ধরা হলো-

কর নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন নয়
কর আদায়ের লক্ষ্যে উপ-কর কমিশনার করদাতার বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য সেবা বন্ধে নোটিশ দিতে পারবেন। করদাতাদের হয়রানি বা কর নির্ধারণে কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ উঠলেও কর কর্মকর্তাদের নামে মামলা করা যাবে না। কর্মকর্তাদের দোষীও করা যাবে না। এক কথায় কর নির্ধারণের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। এমনকি কর পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধও করা যাবে না। কর অফিস যে কর নির্ধারণ করেছে, সেটা নিঃশর্তে মেনে নিতে হবে। আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে করদাতা কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে তাকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে।

আরও পড়ুন>> সহজ হচ্ছে কোম্পানি রিটার্ন দাখিল, বিদেশে সম্পদ থাকলেই জরিমানা

তল্লাশি-জব্দের অসীম ক্ষমতা
নতুন আয়কর আইনে কর কর্মকর্তাদের অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের আয়-সম্পর্কিত রেকর্ড, অর্থ, মূল্যবান ধাতু, গহনা বা অন্য মূল্যবানসামগ্রী বা বস্তু তল্লাশি করতে কর কর্মকর্তারা যেকোনো ভবন, স্থান, জাহাজ, যানবাহন, বিমানে প্রবেশ করতে পারবেন। দরজা, বাক্স, লকার, সেলফ, আলমারি বা অন্য যেকোনো কিছুতে তালা দেওয়া থাকলে, তা ভাঙতে পারবেন। আয়-সম্পর্কিত রেকর্ড, অর্থ, মূল্যবান ধাতুর গহনা বা অন্য মূল্যবানসামগ্রী তল্লাশি করে পাওয়া গেলে জব্দ করতে পারবেন। আয়কর কর্মকর্তার জব্দ করা সামগ্রী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে উপ-কর কমিশনারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।

বাড়ছে জরিমানার পরিধি
যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া আয়কর রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হলে উপ-কর কমিশনার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিরূপণ করা আয়ের ওপর ধার্য করের ১০ শতাংশ হারে জরিমানা আরোপ করতে পারবেন। রিটার্নের ভিত্তিতে কর পরিশোধে ব্যর্থ হলে ২৫ শতাংশ হারে জরিমানা আরোপ করা হবে। আয় গোপন করার ক্ষেত্রেও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ব্যবসাকেন্দ্রের রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র না থাকলে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে। জাল টিআইএন সার্টিফিকেট ব্যবহারে ২০ হাজার টাকা, জাল নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিলে হিসাববিদদের সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি জাল নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়, তাহলে এক লাখ টাকা জরিমানা করতে পারবেন দায়িত্বরত কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন>> আয়কর রিটার্ন জমা সহজ করতে সংসদে বিল

মিথ্যা তথ্য দিলে ৫ বছরের জেল
নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী- কোনো ব্যক্তি আয়কর রিটার্নে মিথ্যা তথ্য দিলে এবং তা প্রমাণ হলে অর্থদণ্ডসহ সর্বনিম্ন ছয়মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কেউ যদি মিথ্যা সনদপত্র দেন, তাহলে সর্বনিম্ন তিনমাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অন্যের টিআইএন সার্টিফিকেট ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কর বকেয়া থাকলে বা খেলাপি হলে বকেয়া করের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা করতে পারবেন উপ-কর কমিশনার। আয়কর কর্তৃপক্ষের কাজে বাধা দিলে ন্যূনতম এক বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

ব্যবসা বন্ধ করলেও জানাতে হবে
ব্যবসার অবসায়ন (বন্ধ বা গুটিয়ে নেওয়া) করলে ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপ-কর কমিশনারের কাছে তা জানাতে হবে। তাহলে ওই অর্থবছরের (যে বছর ব্যবসা বন্ধ হবে) কর দিতে হবে। অন্যথায় ব্যবসা বন্ধ করেও বছরের পর বছর কর দেওয়া থেকে বিরত থাকলে উপ-কর কমিশনার ওই ব্যবসায়ীকে জরিমানা করতে পারবেন।

আরও পড়ুন>> শূন্য রিটার্নেও ন্যূনতম কর না দিলে মিলবে না ৩৮ সেবা

টিআইএন সার্টিফিকেট বাতিলের সুযোগ
করদাতা চাইলে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) বাতিল করতে পারবেন। করদাতার যদি রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা না থাকে বা পরপর তিন বছর করযোগ্য আয় না থাকে বা শারীরিক অক্ষমতার কারণে ভবিষ্যতে করযোগ্য আয় শূন্য থাকে, তাহলে তিনি টিআইএন বাতিলের আবেদন করতে পারবেন। কেউ মারা গেলে, স্থায়ীভাবে দেশ ত্যাগ করলে, একাধিক নিবন্ধন (টিআইএন) বা ভুলবশত নিবন্ধন পেতে থাকলে, আইনি মর্যাদা পরিবর্তন করলে, অন্য কোনো আইনানুগ কারণ থাকলে নিবন্ধন বাতিল করা যাবে। করদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কর বকেয়া না থাকলে বা আয়কর-সংক্রান্ত কোনো বিরোধ না থাকলে রাজস্ব বোর্ড টিআইএন বাতিল করে দেবে।

কালো টাকা সাদা করার বিধান বহাল
নতুন আয়কর আইনে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালো টাকা) দিয়ে জমি, প্লট, ফ্ল্যাট কেনার বিধান বহাল রাখা হয়েছে। আগের নিয়মেই কর দিয়ে অপ্রদর্শিত সম্পদ বৈধ করা যাবে। তবে একাধিক জমি-ফ্ল্যাটের জন্য ২০ শতাংশ বাড়তি হারে কর দিতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বিনিয়োগ করে শিল্প স্থাপনের সুযোগ থাকছে। নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে।

আরও পড়ুন>> ন্যূনতম আয়কর ২ হাজার টাকা

নতুন আয়কর আইনে করদাতার ছয় বছর আগের যেকোনো সময়ের সম্পদ উদঘাটন হলে তার ওপর আয়কর ধার্য করার বিধান রাখা হয়েছে। ফলে সম্পদ লুকিয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কমে যাবে। জানতে চাইলে কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ধরনের বিধান যুক্ত হলে সম্পদ লুকিয়ে রেখে কর এড়িয়ে যাওয়া কিংবা ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কমে যাবে। এতে ট্যাক্স কমপ্ল্যায়েন্স নিশ্চিত হবে। রাজস্ব ফাঁকির প্রবণতাও কমবে।’

নতুন আইনের অন্যান্য বিধান
কোনো ফার্ম বা অ্যাসোসিয়েশনের ফান্ডের বার্ষিক টার্নওভার দুই কোটি টাকার বেশি হলে তার অডিটেড ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট জমা দেওয়া, বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবসাকেন্দ্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র প্রদর্শন করা ও কর রেয়াতের ঊর্ধ্বসীমা কমানো হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, নতুন আয়কর আইনের ৮০ শতাংশই পুরোনো আইন থেকে নেওয়া। ২০ শতাংশ যোগ করা হয়েছে। আইনটিকে সহজভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নতুন আয়কর আইন, ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব হওয়ার পাশাপাশি করদাতাবান্ধবও হবে। আয়কর পরিশোধের সংস্কৃতি তৈরির জন্য জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এতে করে প্রকৃত করদাতাদের কোনো সমস্যা হবে না। কর দিতে নতুন করদাতারাও আগ্রহী হবেন।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন
জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবাস্তব কিছু বিধান যুক্ত করে আইনটাকে দুর্বল করা হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ এসে আমাদের লকার ভেঙে ফেলবেন? এটা খুবই আপত্তিকর কথাবার্তা ও আপত্তিকর আইন। এটা কিন্তু নির্বাচনের বছর। এগুলো ভেবে-চিন্তে দেখা উচিত। এ ধরনের আইন ব্যবসায়ীরা সহজভাবে নেবে না। এসব বিধান থেকে সরে আসার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

আরও পড়ুন>> সঞ্চয়পত্র ভাঙার হিড়িক, সুদাসল মেটাতেই বাড়তি চাপ

কর কর্মকর্তাদের অসীম ক্ষমতা দেওয়ার ফলে অনিয়ম বাড়বে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এতে (নতুন আয়কর আইন) প্রভাবশালীদের কর ফাঁকির প্রবণতা বাড়বে। কর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার প্রবণতাও বাড়বে। সরকারি কোষাগারে রাজস্ব কম জমা পড়বে।’

এসএম/এএএইচ/এএসএম