ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

‘টাকার অভাব’, এডিপিতে কচ্ছপগতি

সাঈদ শিপন | প্রকাশিত: ১২:৫১ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩

চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে দেখা যাচ্ছে কচ্ছপগতি। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার মাত্র ২৩ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এত কম এডিপি বাস্তবায়ন বিগত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে টাকার অভাব দেখা দেওয়ায় এডিপি বাস্তবায়নে এমন ধীরগতি দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বর্তমানে যে সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে নতুন করে টাকা ছাপিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম না করাই ভালো। তবে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে যে অর্থ পাওয়া যাচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে পাওয়া অর্থ দ্রুত ব্যবহার করতে হবে।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জনা গেছে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিতে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ডলারে রয়েছে সংকট। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন এডিপিভুক্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: বৈষম্যের শিকার ময়মনসিংহ বিভাগ, ভুগছে প্রকল্প বাস্তবায়নও

সূত্র জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয়ভাবে এডিপিতে মোট বরাদ্দ ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে জিওবি (সরকারি টাকা) ১ লাখ ৬০ হাজার ১৭০ কোটি ১১ লাখ টাকা। প্রকল্প সাহায্য ৯৫ হাজার ৮৩৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার ২৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম ছয় মাসে এ হার ছিল ২৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। তারও আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ২৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ২৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।

আরও পড়ুন: ‘না ভেবে মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা হবে’

এবার এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, এ বছর তো সরকারের টাকা-পয়সা নেই। সরকারকে আলটিমেটলি এডিপি সংশোধন করতে হবে। প্রকল্প কমাতে হবে।

চলতি বছর অর্থনীতিতে নানামুখী চাপ থাকবে, এটা আগেই অনুমান করা যাচ্ছিল। তারপরও এডিপির আওতায় যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়ন হার সন্তোষজনক কি না জানতে চাইলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এ বছর বাস্তবায়ন না করাটাই ভালো। কারণ টাকা নেই তো। টাকা ছাপিয়ে বাস্তবায়ন করা থেকে না করাই ভালো বলে আমার মনে হয়। কম কম করাই ভালো। শুধু বাস্তবায়ন বাড়ানো উচিত ফরেন ফান্ডের (বৈদেশিক তহবিল) প্রকল্প।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে চলতি বছর এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি রয়েছে। এরই মধ্যে সরকার বিভিন্ন ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট প্রাক্কলন কীভাবে প্রস্তুত করতে হবে সে বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নীতিমালা বা পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বেশকিছু ব্যয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: সরকারের উন্নয়ন প্রচারে ৪৯২ উপজেলায় এলইডি ডিসপ্লে, খরচ ১৬৮ কোটি

এছাড়া গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) প্রণয়নের একটি নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। সেখানে সম্পদের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে সংশোধিত এডিপিতে নতুন প্রকল্প গ্রহণের চেয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে চলমান প্রকল্প শেষ করার ওপর। সেই সঙ্গে ধীরগতি সম্পন্ন প্রকল্প বা রুগণ প্রকল্প থেকে বরাদ্দ হ্রাস করে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য, গতিসম্পন্ন প্রকল্পে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে বলা হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

তিনি জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় এডিপিভুক্ত প্রকল্প তিনটি। এই প্রকল্পগুলোর আওতায় বরাদ্দ দেওয়া অর্থের পরিমাণ ৩৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এরমধ্যে জিওবি থেকে ৪৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্প সাহায্য ৩৫০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। জাতীয় এডিপিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অবদান দশমিক ১৫ শতাংশ।

২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্ব-অর্থায়ন প্রকল্পসহ এডিপিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ব্যয় করেছে ১২২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, যা বরাদ্দ দেওয়া অর্থের ৩০ দশমিক ৭০ শতাংশ। ব্যয় করা অর্থের মধ্যে জিওবি ৯৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রকল্প সাহায্য ১২১ কোটি ৫৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

‘টাকার অভাব’, এডিপিতে কচ্ছপগতি

অন্যদিকে এডিপিতে প্রাপ্ত বরাদ্দের অনুকূলে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থ অবমুক্ত করা হয়েছে ১৭৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, যা এডিপি বরাদ্দের তুলনায় ৪৪ শতাংশ। এরমধ্যে জিওবি অংশ ৩৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ৭৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। প্রকল্প সাহায্য ১৪০ কোটি শূন্য ৮ শতাংশ, যা বরাদ্দের ৪০ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর সভাপতিত্বে চলতি মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় বিভিন্ন সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন এডিপিভুক্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে একটি পর্যালোচনা সভা হয়েছে। সেখানে জানানো হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় এডিপিভুক্ত প্রকল্প রয়েছে তিনটি। এরমধ্যে একটি বিনিয়োগ, একটি কারিগরি এবং একটি স্ব-অর্থায়ন প্রকল্প।

এর মধ্যে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের (আরএমজি) নিরাপত্তাজনিত সংস্কার ও পরিবেশগত উন্নয়ন কারিগরি সহায়তা প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এডিপি বরাদ্দ ২২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। যার সম্পূর্ণ অংশই প্রকল্প সাহায্য। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৩ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার টাকা বা ১৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

এ প্রকল্পের পরিচালক বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মনি শংকর কুন্ডু জানান, প্রকল্পের এডিপি ও নন-এডিপি দুটি অংশের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন। নন-এডিপি অংশের অগ্রগতির ওপর এডিপি অংশের ব্যয় নির্ভর করে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রকল্পের নন-এডিপি অংশের আওতায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্থ অবমুক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় এডিপি অংশের অগ্রগতি কম হয়েছে। প্রকল্পটির নন-এডিপি অংশের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধিতে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাদের সম্মতি পাওয়া গেছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন আরেকটি প্রকল্প ‘বাংলাদেশ বিমা খাত উন্নয়ন প্রকল্প’। এই প্রকল্পে চলতি অর্থবছর এডিপি বরাদ্দ ৩৪১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এরমধ্যে জিওবি ১৪ কোটি টাকা এবং প্রকল্প সাহায্য ৩২৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ১১৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বা ৩৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। এরমধ্যে জিওবি ৯৩ লাখ এবং প্রকল্প সাহায্য ১১৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

এডিপিভুক্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা সভায় এই প্রকল্পের পরিচালক মো. কামরুজ্জামান জানান, প্রকল্পভুক্ত পূর্ত ও পরামর্শক খাতের সব প্যাকেজের ক্রয় কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সভা থেকে প্রকল্পের আওতাভুক্ত সব প্যাকেজের ক্রয় কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে প্যাকেজভিত্তিক অগ্রগতি ও ব্যয় বিবরণী পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করতে বলা হয়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন এডিপিভুক্ত আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে ‘ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ভবন নির্মাণ’। চলতি অর্থবছরে এই প্রকল্পে এডিপি বরাদ্দ ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়ন আগ্রগতি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বা দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

এ প্রকল্পের পরিচালক আইসিবি’র এজিএম মো. আরিফুর রহমান জানান, আইসিবি’র চারটি বেজমেন্টসহ ৪০ তলা ভবন নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পটির স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে পরিবর্তন করা হয়েছে। সেভাবে ভবনটি চারটি বেজমেন্টসহ ৩২ তলা হবে। সে অনুযায়ী বুয়েট থেকে ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়েছে।

৪০ তলার বদলে ৩২ তলা করার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বুয়েটের সুপারিশ অনুযায়ী ৪০ তলার বদলে ভবনটি ৩২ তলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রথম এটা আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এখন এটা আমরা পিডব্লিউডিকে (গণপূর্ত অধিদপ্তর) দিয়ে করাবো। কারণ আমাদের এ ধরনের এক্সপার্ট নেই। এ বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছি। আশা করছি, নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। কাজ শুরু করলে বেশি সময় লাগবে না।

চলতি মাসের ওই পর্যালোচনা সভায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ সম্মিলিতভাবে কাজ করে প্রকল্প বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়ার জন্য এবং বাস্তবায়ন অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার জন্য প্রকল্প পরিচালকদের পরামর্শ দেন। সেইসঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ অর্থ যথাযথভাবে ব্যয়ের জন্য অনুরোধ করেন।

এমএএস/এমএইচআর/এসএইচএস/জেআইএম