পারমাণবিক বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্প
ডলার সংকটে বাদই দিতে হলো পদ্মা-যমুনার ওপর সঞ্চালন লাইন
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের বিদ্যুৎ সারাদেশে সরবরাহ করতে চলছে সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হওয়া প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। এর আওতায় হওয়ার কথা ছিল পদ্মা ও যমুনা নদীর ওপর ২০ কিলোমিটার রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজ। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা। কিন্তু এলসি খুলতে না পারায় ওই অংশের কাজ শুরু করা যায়নি। ফলে চলমান প্রকল্প থেকে বাদ যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন কোনো স্কিমের আওতায় পদ্মা ও যমুনা নদীর ওপর ২০ কিলোমিটার রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
অন্যদিকে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য সঞ্চালন অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক ওই প্রকল্পের অন্যান্য অংশেও দেখা গেছে ধীরগতি। এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির চিত্র উঠে এসেছে আইএমইডি’র পরিদর্শন প্রতিবেদনে।
আরও পড়ুন: জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ঢাকা-চট্টগ্রামসহ ৪ বিভাগ
প্রকল্পটি বেঁধে দেওয়া সময়ে বাস্তবায়নের জন্য পিজিসিবিকে লিখিত প্রতিবেদন দিয়েছে আইএমইডি। আইএমইডি’র পাঠানো সুপারিশের আলোকে নেওয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে পিজিসিবিকে।
আইএমইডি’র প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রকল্পটি গত ২৮ ডিসেম্বর পরিদর্শন করে একটি পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় এক নম্বর প্যাকেজের দুই নম্বর লটের ৪০০ কেভি আমিনবাজার-কালিয়াকৈর ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইনের দৈর্ঘ্য ৫১ কিলোমিটার, কাজের ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৬৪ শতাংশ। এ কাজ বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার সুপারিশ করেছে আইএমইডি।
দুই নম্বর প্যাকেজের ৪০০ কেভি রূপপুর-ঢাকা ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইনের দৈর্ঘ্য ১৪৭ কিলোমিটার। কাজের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ১২ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যে (৩১ ডিসেম্বর ২০২৩) কাজ সম্পন্ন করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
আইএমইডি’র প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, তিন নম্বর প্যাকেজের আওতায় ৪০০ কেভি রূপপুর-গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার সিঙ্গেল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ২১ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যে (৩১ ডিসেম্বর ২০১৩) এ কাজও সম্পন্ন করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলো এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র
চার নম্বর প্যাকেজের আওতায় ২৩০ কেভি রূপপুর-ধামরাই ১৪৫ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে, কাজের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ২৭ শতাংশ।
আইএমইডি আরও জানায়, পাঁচ নম্বর প্যাকেজের ৪০০ কেভি রূপপুর-বগুড়া ১০২ কিলোমিটার সিঙ্গেল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ চলমান। এ অংশের কাজের বাস্তব অগ্রগতি ২৮ শতাংশ। সাত নম্বর প্যাকেজের আওতায় ৪০০ কেভি বে সম্প্রসারণ ও ২৩০ কেভি বে সম্প্রসারণ কাজও সন্তোষজনক নয়।
প্রকল্প সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন আইএমইডি’র সেক্টর-১ এর পরিচালক (উপ-সচিব) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান।
প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা প্রকল্পের সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে পিজিসিবিকে পাঠিয়েছি। আমাদের কিছু সুপারিশমালাও আছে। প্রকল্পের কিছু কিছু প্যাকেজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছি, প্রকল্পটি নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন হবে কি না।
আরও পড়ুন: পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ‘সুইসাইড ট্র্যাপ’
পিজিসিবি জানায়, ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সেই বিদ্যুৎ দেশের ১৩টি জেলায় পৌঁছে দিতে বিশাল ব্যয়ে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এর আওতায় স্থাপন করা হবে ৬০৯ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৯৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার ১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা, সংস্থার নিজস্ব তহবিল ১ হাজার ২৩৫ কোটি এবং প্রকল্প ঋণ ৮ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ হিসেবে এ অর্থ দেবে ভারত। ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় মিলছে এ ঋণ। ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের ১৩টি জেলার ৩৭টি উপজেলায় এই বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন হবে।
স্বল্পমূল্যে জনসাধারণকে বিদ্যুৎ প্রদানের জন্য সরকারের গৃহীত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রূপপুরে দুটি ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন এবং রাশিয়ার মধ্যে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
আরও পড়ুন: আমিরাতের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সন্দিহান ইরান-কাতার
আইএমইডি’র ওই প্রতিবেদন প্রসঙ্গে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী কিউ এম শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আইএমইডি কী প্রতিবেদন দিয়েছে, দেখা হয়নি। তবে কোনো খাতের অগ্রগতি ৫০ শতাংশের কম নয়। প্রকল্প সঠিকভাবে চলমান। আমরা আশা করছি সঠিক সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করতে পারবো।
পদ্মা ও যমুনা নদীর ওপর ২০ কিলোমিটার রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইন তৈরি প্রসঙ্গে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, আমরা নানা কারণে এলসি খুলতে পারছি না। ফলে কাজ শুরু করতে পারিনি। ঠিকাদার টাকা না পেলে কীভাবে কাজ করবে? এজন্য প্রকল্পের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে কাজটি। তবে এই কাজ অন্য একটি স্কিমের আওতায় বাস্তবায়ন করবো। এ কাজে মোট ব্যয় ৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা।
এমওএস/এমএইচআর/এমএস