অনিয়মে জড়াচ্ছে পদ্মা লাইফ, ঠিকমতো পরিশোধ করছে না বিমা দাবি
নানাবিধ অনিয়মে জড়াচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কৃত্রিম উপায়ে লাইফ ফান্ড বাড়িয়ে দেখাচ্ছে কোম্পানিটি। একই সঙ্গে প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে আইন লঙ্ঘন করে দিচ্ছে অতিরিক্ত কমিশন। ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করছে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ। আবার কোনো প্রকার দায় মূল্যায়ন না করেই ঘোষণা করেছে নগদ লভ্যাংশ।
এ ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে এই জীবন বিমা কোম্পানিটির। ফলে বিমা পলিসি গ্রাহকদের দাবির টাকা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না। বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আইডিআরএ সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পদ্মা ইসলামী লাইফের বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে- ধারাবাহিকভাবে কোম্পানিটির প্রথমবর্ষ প্রিমিয়াম আয় ও নবায়ন প্রিমিয়াম আয় কমেছে। কোম্পানির লাইফ ফান্ডে এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি হয়েছে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়।
আরও পড়ুন >> নানাবিধ সংকটে ধুঁকছে পদ্মা লাইফ
পদ্মা ইসলামী লাইফের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, আউটস্ট্যান্ডিং প্রিমিয়াম ইনকাম খাতে প্রতিবছর বড় অঙ্কের অর্থ দেখানো হচ্ছে। এই অর্থ বিবেচনা করা হচ্ছে সম্পত্তি হিসেবে। ২০২১ সালে কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয় ১৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকাই আউটস্ট্যান্ডিং প্রিমিয়াম আয়। অর্থাৎ, নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ৮২ শতাংশই আউটস্ট্যান্ডিং প্রিমিয়াম।
নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ৮২ শতাংশই আউটস্ট্যান্ডিং প্রিমিয়াম আয় যথাযথা না বলে মনে করছে আইডিআরএ। বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি মনে করছে, শুধু লাইফ ফান্ডকে কৃত্রিম উপায়ে বাড়িয়ে দেখানোর জন্য অতিমাত্রায় আউটস্ট্যান্ডিং প্রিমিয়াম আয় দেখানো হচ্ছে। আবার কোনো প্রকার দায় মূল্যায়ন ছাড়াই ২০২১ সালের জন্য কোম্পানিটি ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।
আইডিআরএ’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পদ্মা লাইফ ২০২১ সালের প্রথমবর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ওপর ৫০ শতাংশ কমিশন দিয়েছে। যা নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত। এর মাধ্যমে আইন লঙ্ঘন হয়েছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ফলে দুর্বল হচ্ছে কোম্পানির আর্থিক সামর্থ্য।
আরও পড়ুন >> গোপনে মালিকানা বদলেও ভাগ্য খুলল না পদ্মা লাইফের শেয়ারহোল্ডারদের
জীবন বিমা কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে ২০২০ সালে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে তিন কোটি টাকা। আর ২০২১ অতিরিক্ত ব্যয় করেছে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০২২ সালের অতিরিক্ত ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে অনুমোদিত সীমার মধ্যে রাখার জন্য গত ১৮ অক্টোবর ও ২০ নভেম্বর আইডিআরএ থেকে পদ্মা লাইফকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
আইডিআরএ সূত্রে জানা যায়, ব্যবস্থাপনা খাতে ২০১২ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পদ্মা লাইফ ১৩২ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। চলতি বছর কোম্পানিটি ৩২ কোটি টাকা বিমা দাবি পরিশোধ করলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দাবি বকেয়া রয়েছে ২৩ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২৩ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত ১০৩ কোটি টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করতে হবে। কোম্পানিটি এই বিমা দাবির টাকা পরিশোধ করতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান আইডিআরএ।
এদিকে কোম্পানিটির উদ্বৃত্তপত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৫৬ কোটি টাকা। যার মধ্যে সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সম্পত্তির পরিমাণ ৩১৫ কোটি টাকা। কিন্তু বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানির লাইফ ফান্ডের পরিমাণ মাত্র ১২ কোট টাকা, যা অসমঞ্জস্যপূর্ণ মনে করছে আইডিআরএ। এজন্য কোম্পানিটির কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
আরও পড়ুন >> জীবন বিমার অবৈধ ব্যয় বাড়ছেই
আইডিআরএ’র পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, পদ্মা লইফের মোট সম্পদের মাত্র ১৮ শতাংশ অর্থাৎ, ৫৬ কোটি টাকা রিটার্ন আসে। এমন খাতে বিনিয়োগ করেছে অবশিষ্ট ৮২ শতাংশ সম্পত্তি থেকে কোনো রিটার্ন আসছে না। এতে কোম্পানিটি প্রচুর মুনাফা হারিয়েছে। এছাড়া স্থায়ী সম্পত্তি খাতে পদ্মা লাইফের মোট সম্পদের ৫৪ শতাংশ পুঞ্জিভূত রয়েছে, যেখান থেকে কোনো রিটার্ন আসছে না। স্থায়ী সম্পদ খাতে এত বৃহৎ পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আইডিআরএ।
পদ্মা লাইফের এসব অনিয়মের বিষয়ে কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) চলতি দায়িত্ব পালন করা মো. মোরশেদ আলম সিদ্দিকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান জয়নুল বারী জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা লাইফের বিষয়টি আমরা দেখছি। আমাদের মূল লক্ষ্য গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করা। গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন আমরা নেবো।
এমএএস/এএসএ/এমএস