ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

অস্থিতিশীল বাজার

চিনি সংকটেও ‘কিছুই যায় আসে না’ বিএসএফআইসির

নাজমুল হুসাইন | প্রকাশিত: ০৯:২৭ পিএম, ২৮ অক্টোবর ২০২২

# রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে ইতিহাসের সর্বনিম্ন উৎপাদন
# বিএসএফআইসির অধীনে চিনির মজুত শূন্য
# বিদেশি ৩ কোম্পানির কনসোর্টিয়াম বাস্তবায়নে ‘অনীহা’
# দেনা মওকুফ-ভর্তুকির পেলে ঘুরে দাঁড়াবে চিনিশিল্প
# ৮০০০ কোটি টাকার ঋণে জর্জরিত চিনিকলগুলো

অস্থিতিশীল দেশের চিনির বাজার। বেশি দাম দিয়েও বাজারে মিলছে না চিনি। সরকার দেশের চিনির বাজার স্বাভাবিক করতে হিমশিম খাচ্ছে। অবৈধভাবে মজুতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের কঠোর নির্দেশনা দিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভর্তুকিমূল্যে চিনি বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। তবে এমন সংকটেও যেন ‘কিছুই যায় আসে না’ রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি)। বছর শেষে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও লোকসানের ‘গল্প’ শুনিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় চিনিকলে উৎপাদনের অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে বর্তমানে বাজারে যে সংকট, তা দ্রুত সমাধান হতে পারতো। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি চিনিকল বন্ধের পর বাজার সম্পূর্ণ বেসরকারি রিফাইনারিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এখন চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের হাতে কোনো কার্যকরী উপায় নেই।

বিএসএফআইসি বলছে, সরকারি চিনিকলগুলো গত অর্থবছরে (২০২১-২২) চিনি উৎপাদন করেছে মাত্র ২৪ হাজার ৫০৯ টন। এ উৎপাদন ইতিহাসের রেকর্ড সর্বনিম্ন, যা আগের বছরের তুলনায় অর্ধেক। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে উৎপাদন হয়েছিল ৪৮ হাজার ১৩৩ টন। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা দুই লাখ ১০ হাজার ৪৪০ টন। অর্থাৎ সক্ষমতার চেয়ে প্রকৃত উৎপাদন ৮ ভাগেরও নিচে নেমেছে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন চিনির চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন, যার প্রায় ৯৫ শতাংশই আমদানিনির্ভর।

আরও পড়ুন: টাকা দিয়েও মিলছে না চিনি, হু হু করে বাড়ছে দাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, ‘সরকারের চিনি উৎপাদন কমছেই। এমন না হয়ে যদি বাড়তো, তাহলে বাজারে সেটার বড় প্রভাব থাকতো। যা একটা সময় ছিরও। এ সংকট কাটাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে চিনিকলগুলোকে ভালো অবস্থানে নিতে হবে। এতে আমদানিনির্ভরতা কমবে। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে জনগণের সম্পদও বেহাত হবে না। রিজার্ভের ওপরও চাপ কমবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অব্যাহত লোকসানের মুখে বেশকিছু রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। যে চিনিকলগুলো এখনো উৎপাদনে রয়েছে, তারাও বছরের পর বছর লোকসানের মুখে পড়ছে। বর্তমানে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত করপোরেশনগুলোর মধ্যে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) লোকসানের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

আরও পড়ুন: ৫ বছরে ১ কোটি সাড়ে ১১ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি

শুধু গত পাঁচবছরে বিএসএফআইসির লোকসানের পরিমাণ ছাড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে লোকসান করেছে ৯৩৯ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ৯৭২ কোটি টাকা। তারও আগের বছর লোকসান হয়েছিল ৯৭০ কোটি। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি আট হাজার কোটি টাকার বেশিও ব্যাংক ঋণে জর্জরিত।

মজুতও শূন্য, নেই আমদানির সামর্থ্যও
ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে দেশে চিনির এ সংকটে নিরসনে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না বিএসএফআইসি। ঘাটতি পূরণে এর আগেও সরকারি এ প্রতিষ্ঠানকে চিনি আমদানির তাগিদ দেওয়া হলেও তাতে সাড়া দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। বিএসএফআইসি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, আমদানির জন্য প্রতিষ্ঠানের তহবিলে প্রয়োজনীয় টাকা নেই। তাদেরকে এখন কোনো ব্যাংক ঋণও দেয় না।

জানতে চাইলে বিএসএফআইসি চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান অপু জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে চিনির যে সংকট, তা নিরসনে আমাদের কিছুই করার নেই। আমাদের চিনির স্টকও (মজুত) নেই, আমদানির সামর্থ্য নেই।’

আরও পড়ুন: ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন নেই বাজারে

উৎপাদন বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চেষ্টা করছি। আমাদের কাঁচামাল হচ্ছে আখ, সেটাই নেই এখন। চাইলেই একবারে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। পাঁচবছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। আগামী বছর উৎপাদন হয়তো কিছুটা বাড়বে। সময় লাগবে সুফল পেতে।’

বিদেশি ৩ কোম্পানির কনসোর্টিয়াম বাস্তবায়নে ‘অনীহা’
চিনি শিল্পে সুদিন ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে কয়েকবছর আগে সংযুক্ত আরব-আমিরাত, জাপান ও থাইল্যান্ডের তিন কোম্পানি নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম (সুগার ইন্টারন্যাশনাল) সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সেটি বাস্তবায়ন নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বের শেষ হয়নি।

এ বিনিয়োগে সমস্যা হলো- জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন ও থাইল্যান্ডের এক্সিম ব্যাংক ৭০ শতাংশ টাকা কনসোর্টিয়ামকে ঋণ হিসেবে দেবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার পর চিনিকলগুলোতে লোকসান হলে গ্যারান্টার (জিম্মাদার) হিসেবে দায়-দেনা শোধ করতে হবে বিএসএফআইসিকে। ফলে এ প্রস্তাবে আগ্রহ কম বিএসএফআইসির।

ঋণে জর্জরিত রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল
বিএসএফআইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছে, চিনিকলগুলোর বিপুল এ লোকসানের পেছনে রয়েছে বেশকিছু কারণ। যা মধ্যে অন্যতম আখের সংকট। বেসরকারি খাতের চিনি আমদানি উদারীকরণ, মিলগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন সংকট, কারখানার প্রসেস লস, টেকনিক্যাল সমস্যা, ঋণের সুদ পরিশোধের দায় ও চিনি বিক্রির যথাযথ উদ্যোগের অপ্রতুলতার কারণে দিন দিন বেড়েছে উৎপাদন খরচ

লোকসান কমাতে ২০২০ সালে সরকারি ছয় চিনিকল বন্ধ করেছিল বিএসএফআইসি। সেসময় আখমাড়াই বন্ধ করে বিদেশি বিনিয়োগে জরাজীর্ণ কারখানাগুলো আধুনিকায়নের কথা বলা হয়। সেসব মিলে চিনির পাশাপাশি স্পিরিট, অ্যালকোহলসহ অন্যান্য উপজাত পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনার কথাও শোনা যায়। যদিও বাস্তবে কোনোকিছুই হয়নি এখনো।

আরও পড়ুন: ডলারের চাপে অস্থির তেল-চিনির পাইকারি বাজার

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএসএফআইসি ও রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো ছয় হাজার ৪৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এ ঋণের সুদের পরিমাণ তিন হাজার ৮৫ কোটি টাকা। বর্তমানে সদরদপ্তরের ঋণসহ চিনিকলগুলোকে সাত হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা সুদসহ বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

দেনা মওকুফ-ভর্তুকির পেলে ঘুরে দাঁড়াবে চিনিশিল্প
জানতে চাইলে শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা পুরো খাতকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছি। গত একবছর ধরে এ কাজ চলছে। চলতি মৌসুমের জন্য আখের উৎপাদনও ব্যাপক বাড়ানো হয়েছে। তবে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে একটু সময় লাগবে। অনেক দিন ধরে একটু একটু করে চরম রুগ্ন হয়েছে।’

আরও পড়ুন: টিসিবির ট্রাক থামতেই দীর্ঘ সারি, সবাই চিনির ক্রেতা

তিনি বলেন, ‘দায়-দেনার কারণে এ খাত উঠে দাঁড়াতে পারছে না। এ দায়ও একসঙ্গে তৈরি নয়, বছরের পর বছরের ধরে হয়েছে। এ কারণে এখন চিনির উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে। এক কেজি চিনির উৎপাদন খরচ আড়াইশো টাকা হয়ে গেছে। এজন্য আমারা অর্থ মন্ত্রণালয়কে দেনা মওকুফের জন্য বলেছি। এরপর রুগ্নশিল্প হিসেবে ভর্তুকি দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এসব সুবিধা পাওয়া গেলে বন্ধ মিল চালু হবে। দেশে চিনির ঘাটতি পূরণ না হলেও অংশীদারত্ব অনেক বাড়বে।’

এনএইচ/এএএইচ/এএসএম