ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

আসছে মন্দা, বাড়াতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি

সাঈদ শিপন | প্রকাশিত: ০৯:১২ এএম, ২৭ অক্টোবর ২০২২

ধেয়ে আসছে বিশ্বমন্দা। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আগামী বছর বিশ্বমন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এরই মধ্যে মন্দার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। জোরালো হচ্ছে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একাধিক বক্তব্যে মন্দা ও দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা বলেছেন। সরকারপ্রধান খাদ্যের অপচয় না করা এবং খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে নিম্নআয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা।

তারা বলছেন, বিশ্বমন্দার বিষয়টি বাংলাদেশের হাতে নেই। এটি বৈশ্বিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশের এককভাবে মন্দা থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই। এরই মধ্যে মন্দার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি আঘাত আসে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর। দেশে নানা কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা লোকসংখ্যা বেড়েছে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ত্বরান্বিত করে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন থেকেই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

অর্থনীতিবিদেরা আরও বলছেন, মন্দার প্রভাবে আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ওপর খুব বড় আঘাত আসবে না। কারণ, বাংলাদেশ থেকে তুলনামূলক কম মূল্যের আবশ্যিক পণ্য রপ্তানি করা হয়। এরপরও রপ্তানির নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানি খাতের প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষেত্রে এটা আরও বাড়াতে হবে।

jagonews24

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ‘বিশ্বমন্দা কি আসন্ন’- এমন শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের পর এবার অর্থনীতির গতি সবচেয়ে শ্লথ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের প্রবৃদ্ধি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এর প্রভাব আগামী বছর মন্দায় রূপ নিতে পারে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি এতটা বেড়েছে, যা বিগত ৪০ বছরেও দেখা যায়নি। করোনার প্রকোপ কমতে শুরু করার পর বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম অনেক বেড়েছে। এ প্রভাব সামলাতে চাহিদায় লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। সুদহার বাড়ানোর প্রবণতা অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিচ্ছে।

এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে যে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। এফএও এবং ডব্লিউএফপির যৌথ রিপোর্টে বলা হয়েছে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রবল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার বিভিন্ন বক্তব্যে মন্দা ও দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা বলছেন। সর্বশেষ ১৭ অক্টোবর ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২২’ পালন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আবারও অনুরোধ করছি কোনো খাদ্যের অপচয় নয়, যার যেখানে যতটুকু জমি আছে তা চাষের আওতায় এনে খাদ্য উৎপাদন বাড়ান। সারা বিশ্বে যে দুর্যোগের আভাস আমরা পাচ্ছি, তা থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত করুন। আমি বিশ্বাস করি, সবার প্রচেষ্টায় এটা করা সম্ভব।’

jagonews24

এর আগে গত ১১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘...যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সফরের সময় আমি অনেক বিশ্বনেতা ও সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রত্যেকেই এ বিষয়টি (খাদ্য নিরাপত্তা) নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। তারা মনে করেন, ২০২৩ সাল খুব ভয়াবহ বছর হবে। এ বছরে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ হতে পারে।

বিশ্বমন্দার যে প্রবল আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন রাখা হয় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের কাছে।

উত্তরে তিনি বলেন, মন্দার প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হার কমিয়েছে। তবু এখনো ৬ শতাংশ বা তার ওপরে প্রাক্কলন আছে। সেটা খুব একটা খারাপ পরিস্থিতি না, অনেক দেশের তুলনায় ভালো।

‘তবু অন্যান্য কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা লোকের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য যে বরাদ্দ তা যেন সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার চেষ্টা করছে। প্রায় এক কোটি লোককে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। সেটা যেন সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হয় তা নিশ্চিত করতে হবে’- বলেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, আমাদের বহির্খাতে কিছু সমস্যা আছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহও কমে গিয়েছিল। এখন মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হওয়ায় হয়তো তা বাড়তে পারে। যদিও সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি চলছে। কিছু উন্নত দেশে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। এতে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। সুতরাং রপ্তানি খাতে একটা অভিঘাত আসতে পারে বলে মনে হয়। অন্যদিকে রিজার্ভও অনেক কমে গেছে। রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধি রিকোভারি না করলে রিজার্ভ আরও কমার সম্ভাবনা দেখা দেবে। এতে টাকার বিনিময় হার কমে যাবে, স্থানীয়ভাবে চাপ সৃষ্টি হবে মূল্যস্ফীতির ওপর।

jagonews24

অবশ্য দেশের রপ্তানি আয়ে খুব বড় ধরনের আঘাত আসবে না বলে মনে করছেন আরেক অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের রপ্তানি খাতে খুব একটা প্রভাব আসবে বলে মনে হয় না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে গত ৭-৮ মাসে রপ্তানি বেড়েছে। ইউরোপে আমাদের প্রায় ৪০ শতাংশের মতো রপ্তানি বেড়েছে। আমরা যেসব পণ্য সরবরাহ করি, সেগুলো তুলনামূলক কম মূল্যের। আমাদের রপ্তানি পণ্য বিদেশে কম আয়ের মানুষও কেনে। তবে নতুন নতুন বাজার সন্ধান করতে হবে এবং রপ্তানি খাতে আমরা যে ইনসেনটিভ দিই, সেগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। পারলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বাড়াতে হবে।

রপ্তানি খাতে খুব বড় ধরনের আঘাত আসবে না- এমন আশার কথা শুনিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত-ও। অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা এ অর্থনীতিবিদ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের রপ্তানি হয়তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে খুব বড় আঘাত আসবে না। কারণ, আমাদের রপ্তানি সাধারণত বেসিক কমোডিটি, আমরা খুব হাই জিনিস তৈরি করি না। ২০০৮-০৯ সালের বিশ্বমন্দার সময় আমাদের রপ্তানি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আমরা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বেসিক জিনিস তৈরি করি।

রপ্তানিতে বড় ধরনের আঘাত না এলেও নিম্নআয়ের মানুষের ওপর অভিঘাত আসতে পারে বলেন জানিয়েছেন এই দুই অর্থনীতিবিদ। এজন্য তারাও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে আতিউর রহমান বলেন, এক কোটি পরিবারের খাবারের যে কথা বলা হচ্ছে, আমি মনে করি এটা আরও বাড়ানো উচিত। বিশেষত গার্মেন্টস শ্রমিকদের এ প্রোগ্রামে যুক্ত করা। তারা কারখানা থেকে বাসায় যাওয়ার সময় এক ব্যাগ করে খাবার নিয়ে যাবে এবং মোবাইলে সেই খাবারের দাম পরিশোধ করবে। দরকার হলে মালিক এটা শেয়ার করতে পারে। এরকম করে ইনোভেটিভ ওয়েতে খাদ্য পরিস্থিতি এখন থেকে মোকাবিলা করার চিন্তা করতে হবে।

‘তবে আমি এতটা আতঙ্কিত না। কারণ বাংলাদেশের কৃষির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আমার ধারণা খাদ্য পরিস্থিতি আমরা মোকাবিলা করতে পারবো। তবে টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে যে খাবার দেওয়া হচ্ছে, তার ওপর মনিটরিং বাড়াতে হবে এবং এ সংখ্যাটাও বাড়াতে হবে’- বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর।

তার কথায়- মহামন্দার আভাস আমরা আগে থেকেই পাচ্ছিলাম। এখন পাওয়া যাচ্ছে বেশি করে। কারণ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) বলছে, আগামী বছর সারাবিশ্বের প্রবৃদ্ধি এক দশমিক এক শতাংশ হয়ে যাবে।

jagonews24

তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বলছে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে থাকবে। সরকার আশা করছে ৭-এর ওপরে। সংকটকালে ৬ শতাংশও খারাপ না। এদিক থেকে চিন্তা করলে আমাদের অবস্থা এতো খারাপ না। মন্দার চাপ অবশ্যই পড়ছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের ভেতরের কিছু জায়গায় চাপ পড়ছে। কিন্তু আমরা যদি কৃষির উৎপাদন ঠিকমত করতে পারি, খুব বেশি সমস্যা হবে না।

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সতর্ক বার্তা খুবই সময়োচিত। তিনি মূলত বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি নিয়েই বেশি কথা বলেছেন। আমাদের খাদ্যের একটা বড় অংশ আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ কারণে গম, ভোজ্যতেলের আমদানিমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। আবার এগুলো এলসি করে আনাও বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, দেশে এক ইঞ্চি জমিও যেন পতিত না থাকে।

অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত জাগো নিউজকে বলেন, যুদ্ধ বন্ধ না হলে এক পরিস্থিতি, বন্ধ হলে আরেক পরিস্থিতি। এটা সম্পূর্ণ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দেশের ভেতরে যেটা করতে হবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। কারণ অভিঘাতটা তাদের ওপরই সব থেকে বেশি হয়। মূল্যস্ফীতি বলেন, কর্মসংস্থান হারানো বলেন তাদের ওপরই অভিঘাত বেশি। সুতরাং তাদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে। বিশেষত দরকারি পণ্য তাদের পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন করতে হবে। যেন আমাদের বাজেটের ওপর চাপ কম থাকে।

সাধারণ মানুষের উদ্দেশে তিনি বলেন, একটু ধৈর্য ধরতে হবে। এটি একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। সরকারের যা যা করণীয় সবই করছে। এখানে উত্তেজিত হওয়া বা পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা ঠিক নয়। সবাইকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন করতে হবে।

ড. আতিউর রহমানও বলেন, সাধারণ মানুষকে আয় বুঝে ব্যয় করতে হবে। আতঙ্কিত হলে চলবে না। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে।

এমএএস/এমকেআর/এএসএম