চিনি সংকট: ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন নেই বাজারে
চিনি নিয়ে চালবাজি থামছেই না। ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাজারে সরবরাহ হচ্ছে না সরকার নির্ধারিত দামের চিনি। অথচ একদিন আগেই জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে এক মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছিলেন, মঙ্গলবার থেকে দেশে চিনির সংকট থাকবে না। সরকার নির্ধারিত দাম, অর্থাৎ বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি ৯০ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনি ৯৫ টাকায় বিক্রি করা হবে। কিন্তু আজ সকাল থেকে বাজার ঘুরে মিলেছে বিপরীত চিত্র।
মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁও, তালতলা, মিরপুর এলাকার খুচরা দোকান ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ২০-৩০ টাকা বেশিতে। তালতলার কয়েকটি দোকানে খোলা ও প্যাকেটজাত চিনি ১১০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
সেখানকার বেপারি বিজনেস সেন্টারের ব্যবসায়ী সুলতান জাগো নিউজকে জানান, চিনির দাম কমানোর বিষয়ে ধারণা নেই তার। দুই সপ্তাহ ধরে চিনির দাম ঊর্ধ্বমুখী। কোম্পানি কম দামে চিনি বিক্রি করছে না।
এদিন তালতলা এলাকার অনেক দোকানে খোঁজ নিয়ে খোলা চিনি পাওয়া যায়নি। ক্রেতারা বেশি দামে খোলা চিনি কিনতে চাইছেন না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনের মোমিন স্টোরের স্বত্বাধিকারী মোমিন ইসলাম বলেন, খোলা চিনি বিক্রি করছি না। শিল্প করপোরেশনের আখের চিনি ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। প্যাকেটে যে দাম লেখা সেই দামেই বিক্রি করছি। দুই সপ্তাহ ধরে চিনির দাম বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিলার পয়েন্টস থেকে ডিস্ট্রিবিউশন হলে নতুন দামের চিনি পাওয়া যাবে। তখন দামও কমবে। কোম্পানি এখনো নতুন দামে চিনি ছাড় করছে না। তবে চলতি সপ্তাহের মধ্যে হয়তো নতুন দামের চিনি মিলতে পারে বলে জানান তারা।
দোকানে খোলা চিনি না রাখা প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী মোমিন ইসলাম বলেন, খোলা চিনির দাম বেশি, ক্রেতারা বকাবকি করেন। প্যাকেট চিনিতে দাম লেখা থাকে, তাই ক্রেতাদের কিছু বলার থাকে না।
মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের মেসার্স সঞ্চয়ী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সুবল জাগো নিউজকে বলেন, আমরা প্যাকেট ও খোলা দুই ধরনের চিনিই ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। কোম্পানিকে আজও ফোন দিয়েছি, তারা বলতে পারছে না কবে নতুন দামের চিনি আসবে। আমাদের কেনা দাম ১১০ টাকারও বেশি। বাজারে চিনির সরবরাহও কম।
একই এলাকার মায়ের দোয়া স্টোরে ১১০ টাকা কেজিতে খোলা চিনি বিক্রি করতে দেখা গেছে। দোকানের ব্যবসায়ী সুমন জানান, এক সপ্তাহ আগে চিনি এনেছিলাম। নতুন করে আনিনি। দোকানে সামান্য চিনি আছে, এরপর নতুন দামের চিনি এলে আনবো।
গতকাল সোমবার এক সভায় ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে অপরিশোধিত চিনির কোনো ঘাটতি নেই। তবে গ্যাস সংকটের কারণে চাহিদা মতো চিনি পরিশোধন করতে পারছে না মিলগুলো। ফলে বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। সোমবার রাত থেকেই পরিশোধনকারী মিলগুলো মিলগেটে চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক করবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ওই মতবিনিময় সভায় মঙ্গলবার থেকে বাজারে চিনির সংকট কেটে যাবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেয় বেসরকারি চিনি সরবরাহকারী মিল মালিক ও চিনি ব্যবসায়ীরা। চিনি সরবরাহ ও মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে মিল মালিক, রিফাইনারি, পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে এ সভা বসেছিল।
সভায় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামান বলেন, এর আগে ভোজ্যতেল নিয়েও এমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছিলো। সেখানে কারসাজির প্রমাণ পেয়েছিলাম। চিনির ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা হতে পারে। সেটা দেখছি। তার মানে এই নয় যে, ৯০ টাকার চিনি রাতারাতি কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, তারা চিনি পাচ্ছেন না। কিন্তু আদতে তারা ঠিকই বেশি দামে বিক্রি করছেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিলগুলো তাদের চিনি দিচ্ছে না। কিন্তু তারা যে চিনি বিক্রি করছেন তাতে কোনো ভাউচার নেই। তাহলে নিশ্চয় অনৈতিকভাবে বেশি দামে কেনাবেচা হচ্ছে।
সভায় রিফাইনারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এবং দেশবন্ধু সুগার রিফাইনার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, আমরা পারস্পরিক ব্লেম গেইমে মেতে আছি। আসলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য সবার দায় নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, চিনির সংকট নিয়ে আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলে কথা বলেছি। এতে আমাদের সমস্যাগুলোরও সমাধান হচ্ছে। রাত (সোমবার) থেকে মিলগুলোর সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। এরপর কোনো ভোক্তা বাজারে চিনি না পেলে অভিযোগ দেবেন। আমরা ব্যবস্থা নেবো।
এদিকে সোমবার থেকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ও উন্মুক্ত স্থানে জনসাধারণের কাছে ভর্তুকি মূল্যে চিনি বিক্রির কার্যক্রম শুরু করেছে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি। সংস্থাটির ট্রাক সেলে প্রতি কেজি ৫৫ টাকা দরে চিনি কিনতে পারছেন সাধারণ মানুষ। এজন্য টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডেরও প্রয়োজন হচ্ছে না। মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে দেখা গেছে, এক কেজি চিনি কিনতে ভোক্তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ভর্তুকি দামে টিসিবির এই চিনি বিক্রি চলবে।
এসএম/এমকেআর/জিকেএস