ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

সংকটে প্রগ্রেসিভ লাইফ

সাঈদ শিপন | প্রকাশিত: ১০:১৬ এএম, ৩০ আগস্ট ২০২২

একদিকে আয় কমছে, অন্যদিকে আইন লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর অবৈধভাবে ব্যয় করা হচ্ছে গ্রাহকদের টাকা। এতে দুর্বল হচ্ছে আর্থিক অবস্থা। ভাঙতে হচ্ছে বিনিয়োগ। কমে যাচ্ছে জীবন তহবিল (লাইফ ফান্ড)। সব মিলে সংকটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বিমা কোম্পানি প্রগ্রেসিভ লাইফ।

কোম্পানিটির ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালের আর্থিক তথ্য পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া যায়।

জানা গেছে, প্রগ্রেসিভ লাইফের ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষা করে নিরীক্ষক কোম্পানিটির অ্যাকাউন্টস ও ডকুমেন্টস রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবের অস্বাভাবিক তথ্য পান। একই সঙ্গে কোম্পানিটির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও কমপ্লায়েন্স পরিপালন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন নিরীক্ষক। জীবন বিমা কোম্পানিটির সার্বিক চিত্র পর্যালোচনা করে নিরীক্ষক অভিমত দেন, কোম্পানিটি ব্যবসা পরিচালনায় উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

আরও পড়ুন: নানাবিধ সংকটে ধুঁকছে পদ্মা লাইফ

এমন অভিমত দেওয়ার পরও গত কয়েক বছরে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা উন্নতির বদলে আরও অবনতি হয়েছে। একদিকে কমেছে ব্যবসা, অন্যদিকে ভাঙা হয়েছে বিনিয়োগ। আবার আইনের তোয়াক্কা না করে গ্রাহকের টাকা ব্যয় করা হয়েছে অবৈধভাবে।

কোম্পানিটির ব্যবসার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় হয় ২১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। সেই আয় কমতে কমতে ২০২১ সালে এসে ১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকায় নেমেছে। প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের মতো নবায়ন প্রিমিয়াম আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৬ সালে কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয় ৫৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সেটি ধারাবাহিকভাবে কমে ২০২১ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ২৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকায়।

একটি জীবন বিমা কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে তা আইনে নির্ধারিত। সে অনুযায়ী সবশেষ সমাপ্ত বছর ২০২১ সালে প্রগ্রেসিভ লাইফের ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত ছিল ১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। তবে ওই বছর কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ২৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি ৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।

আরও পড়ুন: গ্রাহকের টাকা অবৈধভাবে খরচ করছে ডায়মন্ড লাইফ

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালের আগের বছরগুলোতেও এই জীবন বিমা কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে। ২০২০ সালে কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করে ৯ কোটি ৯ লাখ টাকা। বছরটিতে ব্যবস্থাপনা খাতে কোম্পানিটির সর্বোচ্চ ব্যয় নির্ধারিত ছিল ১৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। তবে কোম্পানিটি ব্যয় করে ২৪ কোটি ৭ লাখ টাকা।

এ খাতে ২০১৯ সালে ৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা অবৈধভাবে খরচ করে এই জীবন বিমা কোম্পানিটি। আইন অনুযায়ী, বছরটিতে ব্যবস্থাপনা খাতে প্রগ্রেসিভ লাইফের ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত ছিল ১৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি ব্যয় করে ২৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

বছরের পর বছর অবৈধভাবে ব্যয় করায় কোম্পানির আর্থিক অবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে ভাঙতে হয়েছে বিনিয়োগ। ২০২০ সালে কোম্পানিটির বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা কমে ২০২১ সালে ২৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকায় নেমেছে। অর্থাৎ এক বছরে কোম্পানিটি ১৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ ভেঙেছে।

একটি জীবন বিমা কোম্পানির প্রাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় লাইফ ফান্ড বা জীবন তহবিলকে। প্রগ্রেসিভ লাইফের এই লাইফ ফান্ডেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। ২০২১ সালের শুরুতে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ২৭৩ কোটি ১১ লাখ টাকা, যা বছর শেষে কমে ২৪৯ কোটি ৫১ লাখ টাকায় নেমেছে। অর্থাৎ লাইফ ফান্ড ২৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা কমে গেছে। আগের বছর ২০২০ সালেও কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড কমে। ২০২০ সালের শুরুতে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ২৭৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, যা বছর শেষে দাঁড়ায় ২৭৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে লাইফ ফান্ড কমেছে ২৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন: বিমার প্রতি আস্থা ফেরানো প্রধান লক্ষ্য: আইডিআরএ চেয়ারম্যান

এ বিষয়ে একাধিক বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, লাইফ ফান্ডকে একটি জীবন বিমা কোম্পানির রক্তের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মানুষ রক্তশূন্য হয়ে পড়লে যেমন বাঁচে না, তেমনি জীবন বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়লে ওই কোম্পানি সংকটের মধ্যে পড়ে। যে কোম্পানির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক, সে কোম্পানিতে গ্রাহকের টাকা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গ্রাহক তার জমা করা টাকা ফেরত পাবেন কি না, তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। লাইফ ফান্ড পজিটিভ থাকার পরও ধারাবাহিকভাবে তা কমতে থাকলে বুঝতে হবে কোম্পানির ব্যয় বেশি হচ্ছে, কিন্তু আয় কম হচ্ছে। অর্থাৎ কোম্পানিটি সংকটের মধ্যে পড়েছে।

প্রগ্রেসিভ লাইফের নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতি বছর কোম্পানিটি নতুন যে প্রিমিয়াম আয় করছে পরবর্তী বছরে নবায়ন প্রিমিয়াম বাবদ আদায় হচ্ছে তার খুবই নগণ্য। ২০২১ সালে কোম্পানিটি দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়াম আয় করেছে ৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অথচ আগের বছর কোম্পানিটি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করে ৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা। অর্থাৎ নবায়নে কোম্পানিটি মাত্র ৩৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ আদায় করতে পেরেছে।

আগের বছর (২০২০ সাল) দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় হয় ৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অথচ ২০১৯ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় হয় ১১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অর্থাৎ সে বছর কোম্পানিটি মাত্র ৩৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় করতে পেরেছে। এ হিসেবে কোম্পানিটি নতুন বিমা পলিসি বিক্রি করে যে প্রিমিয়াম আয় করছে, পরের বছরই তার ৬০ শতাংশের বেশি আর আদায় হচ্ছে না।

প্রগ্রেসিভ লাইফের প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম ও নবায়ন প্রিমিয়ারের চিত্রকে সন্দেহজনক বলছেন বিমা খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দ্বিতীয় বছরের নবায়ন প্রিমিয়াম আয় ৬০ শতাংশ কমে যাওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কোম্পানি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় যা দেখাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে আয় তা হচ্ছে কি না? নাকি অতিরিক্ত প্রিমিয়াম দেখিয়ে কোম্পানি থেকে কমিশনসহ বিভিন্ন খাতের খরচ বাবদ টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) খতিয়ে দেখা উচিত।

সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রগ্রেসিভ লাইফের সিইও অজিত চন্দ্র আইচ জাগো নিউজকে বলেন, এখন সব খাতেই খরচ বেড়েছে। আবার আয় কম হচ্ছে। এ কারণে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেশি হয়েছে। শুধু প্রগ্রেসিভ লাইফ নয়, এখন জীবন ও সাধারণ সব বিমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি, ব্যবস্থাপনা ব্যয়কে আইনি সীমার মধ্যে নিয়ে আসার।

দ্বিতীয় বর্ষেই নবায়ন প্রিমিয়াম ৬০ শতাংশের বেশি আদায় হচ্ছে না এবং লাইফ ফান্ড কমে যাচ্ছে। এটি জীবন বিমা কোম্পানির জন্য খারাপ লক্ষণ। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় নির্ভর করে গ্রাহকের আর্থিক সচ্ছলতা, যোগাযোগ ও সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের ওপর। একসময় আমাদের অ্যানালগ পদ্ধতি ছিল, এখন আমরা সফটওয়্যারে চলে গেছি। এখন নবায়নটা ধীরে ধীরে বাড়বে। আর নবায়ন প্রিমিয়াম আয় কম হলে স্বাভাবিকভাবেই লাইফ ফান্ডের ওপর চাপ বাড়ে।

তিনি আরও বলেন, ২০২১ সাল থেকে আমরা ভালো পদক্ষেপ নিচ্ছি। ইনশাল্লাহ আমাদের নবায়ন প্রিমিয়াম আয় বাড়বে। ব্যবস্থাপনা ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে চলে আসবে। গ্রাহকসেবা বাড়বে।

এমএএস/এমএইচআর/এএসএ/জেআইএম