ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

দেশের একমাত্র সনদধারী চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারক রিফ লেদার

ইকবাল হোসেন | প্রকাশিত: ০৬:৪৬ পিএম, ০৭ জুলাই ২০২২

রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের পর দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। কাঁচা চামড়ার অবারিত উৎস থাকার পরও কমপ্লায়েন্স জটিলতায় এগোতে পারছে না দেশের প্রায় দুইশ ট্যানারি। যে কারণে এ শিল্পে বিনিয়োগ করেও হতাশায় উদ্যোক্তারা। তবে সব বাধা পেরিয়ে বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে চট্টগ্রামের রিফ লেদার। চামড়া শিল্পের বৈশ্বিক মানসনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) থেকে সব ধাপের সনদ পাওয়া একমাত্র প্রতিষ্ঠান এটি।

বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকায় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির পূর্বশর্ত হচ্ছে এলডব্লিউজির সনদধারী হওয়া। এ খাতের অভিজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে চামড়াশিল্পে আন্তর্জাতিকভাবে এলডব্লিউজির সনদধারী হতে হয়। কমপ্লায়েন্স জটিলতা কাটিয়ে এলডব্লিউজির সনদ অর্জন করা গেলে বাংলাদেশ থেকে চামড়া ও চামড়াজাত রপ্তানি পণ্য হু হু করে বেড়ে যাবে। বিদেশি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোও বাংলাদেশে বিনিয়োগে ঝুঁকবে।

রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড সেলস) মো. মোখলেসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে চামড়ার বাজার সম্প্রসারণের জন্য ঢাকার ট্যানারিগুলোর ইটিপি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

‘চট্টগ্রামে বর্তমানে ইটিপিসহ সব ধরনের কমপ্লায়েন্স মেনে কাজ করছে রিফ লেদার। আমাদের এলডব্লিউজির সনদ রয়েছে। এতে চামড়াজাত পণ্যের বিদেশি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের রিফ লেদারের চামড়া ও চামড়াপণ্য নিতে আগ্রহী হচ্ছে। বর্তমানে বছরে ৮০ কোটি টাকার মতো চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত রপ্তানি আদেশ বাড়ছে।’

jagonews24

এ কর্মকর্তা বলেন, রাজধানী ঢাকা ও সাভারের হেমায়েতপুরে প্রায় দুইশ ট্যানারি রয়েছে। এখানে এখনো সেন্ট্রাল ইটিপি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সরকার যদি এসব প্রতিষ্ঠানে ইটিপি বাস্তবায়নে সহায়তা দেয় তাহলে তারাও এলডব্লিউজির সনদ পেতে পারেন। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের তৈরি চামড়ার চাহিদা আরও বাড়বে।

‘চামড়াশিল্পে বিনিয়োগকারীরা হতাশার মধ্যে রয়েছেন। কমপ্লায়েন্স জটিলতার কারণে বিনিয়োগ থাকলেও তারা রপ্তানি করতে পারছে না। আমাদের ‘ওয়েট ব্লু’ (পশম ছাড়ানো চামড়া) ‘ক্রাস্ট’ (পশম ছাড়ানোর পরের ধাপ, পাকা চামড়া) ও ‘ফিনিশড’ (চামড়াজাত যে কোনো পণ্য তৈরির উপযোগী) তিন ধাপে এলডব্লিউজির সনদ রয়েছে। আমাদের কারখানায় কাঁচা চামড়া থেকে শুরু করে শেষ ধাপে চামড়া ও চামড়াজাত সব ধরনের পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি সম্ভব। আমরা বাদে ঢাকার দুই প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজির সনদ থাকলেও সবগুলো সনদ নেই। যে কারণে তারা কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে পারে না।’

তিনি বলেন, রপ্তানিযোগ্য চামড়াজাত পণ্য তৈরির জন্য তারা ওয়েট ব্লু কিংবা ফিনিশড লেদার আমাদের কাছ থেকে কিনে নেয়। কারণ এলডব্লিউজির সনদ রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ওয়েট ব্লু ও ফিনিশড লেদার তাদের আমদানি কিংবা কিনতে হয়। চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে রিফ লেদারেই কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে ফিনিশড লেদার তৈরি করা হয়। চামড়া শিল্পের এ অভিজ্ঞ ব্যক্তি বলেন, চাহিদা না থাকলে তো ট্যানারিগুলো কাঁচা চামড়া কিনবে না। এতে প্রতিবছর কোরবানি এলে চামড়া নিয়ে বিপর্যয় তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়ার চাহিদা বাড়লে এ বিপর্যয় থাকবে না। কোরবানিতে চামড়ার ন্যায্যমূল্যও মিলবে।

এজন্য ঢাকার ট্যানারিগুলোতে ইটিপি বাস্তবায়নে সরকারি সহযোগিতার পরামর্শ দেন তিনি।

jagonews24

তিনি বলেন, সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে এলডব্লিউজি তিনটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পরিবেশগত। চামড়াশিল্পের কারখানাগুলো হতে হবে শতভাগ পরিবেশবান্ধব। থাকতে হবে শতভাগ ইটিপি (বর্জ্য শোধন প্ল্যান্ট)। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা। আবার লেদার শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো এনার্জি এফিসিয়েন্ট কি না, সেটাও দেখে এলডব্লিউজি। এগুলো নিশ্চিত করা গেলে এলডব্লিউজির সনদ পাওয়া সহজ।

জানা যায়, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য আমদানি-রপ্তানিতেও রয়েছে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত থেকে শুরু করে পাকা চামড়া উৎপাদন এবং চামড়াজাত পণ্য তৈরির বিভিন্ন ধাপে বৈশ্বিক মানসনদ দেয় লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি)। সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর নিরীক্ষা ও পরিদর্শন করে এলডব্লিউজি। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির জন্য এলডব্লিউজির সদস্য হতে হয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। শুধু এলডব্লিউজির সদস্য হতে না পারার কারণে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও চামড়া শিল্পে এগোতে পারছে না বাংলাদেশ।

ট্যানারি শিল্পে তিন ধাপের জন্য সনদ দেয় যুক্তরাজ্যভিত্তিক অলাভজনক এ সংগঠনটি। প্রত্যেকটি ধাপের সনদধারী বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান রিফ লেদার লিমিটেড। ঢাকার অ্যাদপেক্স ফুটওয়্যার ও এবিসি লেদারের এলডব্লিউজি শেষ ধাপের সনদ থাকলেও প্রথম ধাপের ওয়েট ব্লু সনদ নেই। যে কারণে তারা কাঁচা চামড়া থেকে চামড়া তৈরি করতে পারে না।

চামড়াশিল্পে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আন্তর্জাতিক জনপ্রিয় চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারী ব্র্যান্ড নাইকি, অ্যাডিডাস, বারবেরি-লন্ডন, ড. মার্টিনস্, আইকেয়া, ক্লার্ক্স, এসুস, নিউ ব্যালেন্স, মালভেরি তাদের পণ্য আমদানিতে এলডব্লিউজির সনদধারী প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেয়।

jagonews24

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে (২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১০৩ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১২৪ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার আয় হয়েছে বাংলাদেশের। আগের ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। আগের বছরের তুলনায় সদ্য বিগত অর্থবছরে ৩২ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি রপ্তানি হয়েছে এ খাতে।

চট্টগ্রামে চামড়াশিল্পে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রামে ২২টি ট্যানারি ছিল। এর মধ্যে পরিবেশগতসহ নানান সমস্যার কারণে ২১টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে শুধু রিফ লেদার (ট্যানারি) চালু রয়েছে। ১৯৯১ সালে নগরীর কালুরঘাট শিল্প এলাকায় রিফ লেদার প্রতিষ্ঠা করে চট্টগ্রামের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপ।

রিফ লেদারের ডিজিএম (প্রোডাকশন) ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘চামড়াশিল্প সম্প্রসারণের জন্য প্রথম ইস্যু হচ্ছে কমপ্লায়েন্স। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য অর্ডার করার সময় বিদেশি ব্র্যান্ডের বায়াররা প্রথম দেখেন প্রতিষ্ঠান কমপ্লায়েন্স কি না। এখন বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। শুধু এলডব্লিউজির সনদ থাকলে চামড়াশিল্পে বাংলাদেশ অনেক দূরে এগিয়ে যেতে পারবে। আমেরিকা ও ইউরোপের আন্তর্জাতিক জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ। ভারত, পাকিস্তান কিংবা ভিয়েতনাম নয়।’

jagonews24

‘আমেরিকা ও ইউরোপের বায়াররা বিনিয়োগের জন্য এখন বাংলাদেশকে পছন্দ করছে। আমার মনে হয় তৈরি পোশাকের পর বাংলাদেশে লেদারগুডস তৈরির কারখানাও আগের চেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হবে। বিদেশি ব্র্যান্ডের জুতা কিংবা চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা তৈরি চামড়া সরবরাহ করতে পারলে বাংলাদেশের কাঁচা চামড়ার কদরও বাড়বে। অথচ আমাদের কাঁচা চামড়ার কোনো অভাব নেই।’

তিনি বলেন, ‘এলডব্লিউজির সনদ না থাকায় এখন বাধ্য হয়েই কাঁচা চামড়া রপ্তানি করতে হচ্ছে। এলডব্লিউজির ওয়েট ব্লু সনদ থাকলে আন্তর্জাতিক রুলস মেনেই কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা যেত। যেহেতু কাঁচা চামড়া আমাদের দেশের, সেহেতু কাঁচা চামড়া থেকে ফিনিশড চামড়া তৈরি করা গেলে আমাদের অনেক ভ্যালু এডিশন হতো। এতে এ শিল্প থেকে আরও বেশি লাভবান
হতো দেশ।

এএসএ/জিকেএস