পদ্মা সেতু নির্মাণে যত দেশি উপকরণ
পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো স্টিলের। এই কাঠামো আনা হয়েছে চীন থেকে। দেশটি থেকে রেললাইনের কিছু উপকরণও আনা হয়েছে। কিছু উপকরণ আনা হয়েছে ইউরোপের দেশ লুক্সেমবার্গ থেকে। তবে বিশাল এই অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণের বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে দেশি উপকরণ। বিশেষ করে সিমেন্ট, রড, জিও ব্যাগসহ ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে দেশি উৎস থেকে।
পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত উপকরণের একটি তালিকা করেছে। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার সেতু প্রকল্পে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে তার ২৫ শতাংশের জোগান এসেছে দেশের ভেতর থেকেই। মূল সেতুতে ৩০টি উপকরণের ব্যবহার বেশি হয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রকল্পে বড় দুটি ঠিকাদার কোম্পানি চায়নিজ। এই কোম্পানিকে দেশীয় নানা পণ্য ব্যবহারে তাগাদা দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পে ব্যবহৃত রড, সিমেন্ট, ইট ও বালুর চাহিদা পূরণ হয়েছে বাংলাদেশের নানা কোম্পানির মাধ্যমে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগ্রুপ প্রাণ-আরএফএল-এর মতো অনেক প্রতিষ্ঠান পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে নানাভাবে অংশীদার হয়েছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (পিডিএল) ও রেইনবো পেইন্টস কাজ করেছে পদ্মা সেতুতে।
সেতুতে কাজ করা প্রসঙ্গে আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এন পাল বলেন, এই সেতুর সঙ্গে কানেক্টিং এন-৮ রোড আছে। তার একটা অংশ আমরা তৈরি করেছি। ব্রিজের ওপর বিটুমিনের ওয়ার্কটাও আমরা করেছি। পাশাপাশি এই বিটুমিনের ওপর রোডমার্কের কাজটাও রেইনবো পেইন্টসের সৌজন্যে আমরা করতে পেরেছি। ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছি আমরা। এতে সত্যিই আনন্দিত।
দেশের শীর্ষ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম মোট রডের ৮৫ শতাংশ সরবরাহ করেছে সেতু প্রকল্পে। ব্যবহার হয়েছে বসুন্ধরা সিমেন্ট। পদ্মা সেতু প্রকল্পের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল নদীশাসন। চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন এ কাজ করেছে। এ কাজে ৪ কোটিরও বেশি জিও ব্যাগ স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ডার্ড ফেল্ট লিমিটেড দিয়েছে। সেতু প্রকল্পে মৌলভীবাজার থেকে আনা ৫শ কোটি ঘনফুটের বেশি বালু ব্যবহার করা হয়েছে।
নদী শাসনে ফেলা হয়েছে এমন লাখো জিও ব্যাগ, ফাইল ছবি
নদীতে ৪৩টি ও ডাঙায় ৭৬টিসহ মোট ১১৮টি পিলারের পুরো রড, সিমেন্ট, কংক্রিট ও বালু সরবরাহ করেছে দেশীয় নানা প্রতিষ্ঠান। সংযোগ সড়কসহ পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ১ লাখ টন রড ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে পিলার ও নদীশাসনে ৮৬ হাজার টন রডের একক জোগানদাতা বিএসআরএম। বাকি রডও সরবরাহ করেছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রকল্পের অ্যাপ্রোচ রোডের শতভাগ করা হয়েছে বসুন্ধরা সিমেন্ট ব্যবহার করে। রিভার ট্রেনিংয়ের কাজেও বসুন্ধরা মূল সরবরাহকারী। মূল সেতুতে স্ক্যান সিমেন্টের সঙ্গে বসুন্ধরার অংশীদারত্ব ছিল। নদীশাসনের কাজে চার লাখ টন সিমেন্ট সরবরাহ করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা। ক্রাউন সিমেন্ট দিয়েছে ৯ হাজার টন। সিমেন্ট এসেছে আবুল খায়ের গ্রুপের শাহ সিমেন্ট এবং সেভেন সার্কেল গ্রুপের সেভেন রিংস সিমেন্ট থেকেও।
প্রকল্পে ব্যবহৃত পাথর অবশ্য এসেছে বিদেশ থেকে। নদীশাসনের জন্য ১১ লাখ ঘন মিটার ও মূল ব্রিজের জন্য ১০ লাখ ঘনমিটার পাথর এসেছে দুবাই, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।
সেতুর মূল ঠিকাদার চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন। নদীশাসন ও মূল সেতুর কাজে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে এই দুটি কোম্পানির মাধ্যমে।
এর বাইরে দক্ষিণ কোরিয়ার কে এ সি, মালয়েশিয়ান এইচসিএম জেভির সঙ্গে কাজ করেছে বাংলাদেশের আব্দুল মোনেম লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানটি মাওয়া সংযোগ সড়কে এইচসিএম জেভির সঙ্গে যৌথভাবে ১৯৩ কোটি টাকা, জাজিরা সংযোগ সড়কে একই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় ১১শ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। সার্ভিস এরিয়া-২ নির্মাণে ২০৩ কোটি টাকার প্রকল্পের পুরোটাই করেছে আব্দুল মোনেম লিমিটেড।
দেশে তৈরি বিদ্যুতের ক্যাবল ব্যবহার হয়েছে প্রায় পৌনে ৩ লাখ মিটার এবং পাইপ এক লাখ ২০ হাজার মিটার, যা বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত।
সেতুতে ২০ দেশের মেধা
বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নানান ভূমিকা রেখেছেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। সেই ধারাবাহিকতায় পদ্মা সেতু নির্মাণেও বড় অবদান রেখেছেন তিনি। এছাড়া পদ্মা সেতুতে বাংলাদেশসহ অন্তত ২০টি দেশের মেধা কাজ করেছে। অর্থাৎ ২০ দেশের বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ান ও কর্মীর মেধা-শ্রমে এই পদ্মা সেতু।
মূল সেতুর কাজে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লুক্সেমবার্গ, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়া নানান উপকরণের জোগান দিয়েছে। এর বাইরে সেতুর কাজে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসসহ আরও অনেক দেশের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের তিনটি বড় কন্ট্রাক্ট ছিল পদ্মা সেতুতে। মূল সেতু, নদীশাসন ও অ্যাপ্রোচ রোড। মূল সেতু ও নদীশাসনে চীনা ঠিকাদার। অ্যাপ্রোচ রোডে আবদুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল) ও মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানি যৌথভাবে কাজ করেছে। আমাদের সক্ষমতা না থাকায় বিদেশি ঠিকাদার আনতে হয়েছে। তবে বিদেশি ঠিকাদারদের বলেছি তোমরা দেশি ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহার করবা। প্রকল্পে সিমেন্ট, বালু বাংলাদেশের। কিন্তু পাথর বাংলাদেশের ব্যবহার হয়নি, কারণ এই পাথর বাংলাদেশে নেই।
এমওএস/এমএইচআর/এএসএ/এমএস