চার ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালজুড়েই ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা ছিল ব্যবসায়ীদের। এসব সুবিধার কারণে ওই সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করেও কাউকে খেলাপি হতে হয়নি। তবে বিশেষ সুবিধা না থাকায় খেলাপি ঋণের অংকটা বেড়েই চলছে। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
ব্যাপকহারে খেলাপি ঋণ বাড়ায় পুরো ব্যাংক খাতই ঋণমান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। মার্চ প্রান্তিক শেষে আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে একটি ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে জমা রাখতে হয়। অর্থাৎ কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ (খেলাপি) ঋণে পরিণত হলে তাতে ব্যাংক যেন আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য প্রভিশন রাখার নিয়ম রয়েছে। ২০২২ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৭০ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। ফলে সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। তবে কোনো কোনো ব্যাংক অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেওয়ায় সার্বিকভাবে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। সার্বিকভাবে মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে সার্বিকভাবে ছিল ১৪ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।
প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ আট ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি। যাদের প্রভিশন ঘাটতি ১৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা।
আলোচিত সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের। এ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৮ হাজার ১৩৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘাটতি বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ১০৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৩ হাজার ২২৫ কোটি ৪১ লাখ এবং রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৫৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে মার্চ শেষে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের। বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১১১ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর পরই রয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, যাদের ঘাটতির পরিমাণ ৩৩১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এছাড়া স্টান্ডার্ড ব্যাংকের ১৪৬ কোটি ৩১ লাখ এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৩৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।
চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা গত বছরের (২০২১ সালের মার্চ প্রান্তিক) একই সময়ে ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তিন মাসের তুলনায় বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, দেশের ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ৫০টিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই বেসরকারি ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, কোভিডের পর কিছুটা মন্থর হয়েছে সবকিছু। এখন আবার ইউক্রেন সংকট আসায় একটা টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে এক্সপোর্ট (রপ্তানি) কমে যাচ্ছে, রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে, ইমপোর্ট (আমদানি) বাড়ছে। ইমপোর্ট পেমেন্ট পরিশোধে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সবাই। কিন্তু ঋণ আদায় করার ব্যাপারে রিলাক্স ভাব। এতে মূল স্তম্ভই তো দুর্বল হচ্ছে, খেলাপি বাড়ছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকাররা ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, তেলের দাম নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। খেলাপি নিয়ে ব্যাংকারদের খেয়াল নেই। এখন ঋণ আদায় ঢিলে হয়ে গেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংক খাতের জন্য খারাপ জিনিস। এটা সাধারণ মানুষ জানলে ব্যাংকগুলোর প্রতি আস্থা কমে যাবে। খেলাপি-প্রভিশন নিয়ে সরকারকে কড়া নজর দিতে হবে। আমাদের কদিন পরই নতুন বাজেট আসছে, সেখানে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। সরকারকে এখন ব্যাংকনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে প্রদক্ষেপ নিতে হবে।
ইএআর/ইএ/এএসএম