ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

কমেছে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ, সক্রিয় বড় বিনিয়োগকারীরা

সাঈদ শিপন | প্রকাশিত: ০৯:৪৪ পিএম, ০৪ জুন ২০২২

দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ছিল। পাশাপাশি অনেকটা নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা। এতে টানা দরপতনের মধ্যে পড়ে শেয়ারবাজার। নির্বিশেষ প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের দরপতন হওয়ায় মাত্র আট কার্যদিবসে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ৫৫৫ পয়েন্ট পড়ে যায়। এতে বড় অঙ্কের পুঁজি হারিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত বিনিয়োগকারীরা।

এ পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্বশীলরা শেয়ারবাজার ভালো করতে বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে জারি করা হয় একের পর এক নির্দেশনা। আর্থিকখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। সরকারের দায়িত্বশীলদের এমন ভূমিকার কারণে আবারও বাজারে বেড়েছে বড় বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ।

অন্যদিকে বড় পতনে অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম কমে যাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিক্রির চাপ কমেছে। যার সুফলও পেয়েছে দেশের শেয়ারবাজার। গত সপ্তাহে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসই সূচক ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এতে আবারও লোকসান কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন বিনিয়োগকারীরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজারে যে ধরনের দরপতন হয়েছে তাতে ভালো অনেক কোম্পানির শেয়ার দাম যৌক্তিক মূল্যের নিচে চলে যায়। এ ধরনের দরপতনের পর বাজার ঘুরে দাঁড়ানোটাই স্বাভাবিক ছিল। তাছাড়া দরপতনের পর সরকারের দায়িত্বশীলরাও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের যুক্তিসঙ্গত আচরণ করতে হবে। অহেতুক প্যানিক না হয়ে বিনিয়োগ করতে হবে ভালো কোম্পানি বাছাই করে। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন থেকে সরে আসতে হবে। বাজার চলতে দিতে হবে তার নিজস্ব গতিতে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১০ থেকে ২২ মে পর্যন্ত লেনদেন হওয়া আট কার্যদিবস শেয়ারবাজারে টানা দরপতন হয়। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমে ৫৫৫ পয়েন্ট। বাজার এমন পতনের মধ্যে পড়ায় ২২ মে মার্জিন ঋণের হার বাড়িয়ে নতুন নির্দেশনা জারি করে বিএসইসি। মার্জিন ঋণের হার ১ : ০.৮ থেকে বাড়িয়ে ১ : ১ করা হয়।

বিএসইসি থেকে মার্জিন ঋণের হার বাড়ানোর পাশাপাশি ওইদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, সিনিয়র অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার এবং আর্থিকপ্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাসকে নিয়ে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৈঠকে শেয়ারবাজার ভালো করতে দিকনির্দেশনা দেন।

অর্থমন্ত্রী ও বিএসইসি থেকে এমন পদক্ষেপ নেওয়ায় ২৩ মে শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হয়। টানা দরপতন থেকে বেরিয়ে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক একদিনেই বাড়ে ১১৮ পয়েন্ট। সূচকের এমন উত্থানের পরপরই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আইপিও আবেদনের বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্তের কথা জানায় বিএসইসি।

বিএসইসির এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আইপিও আবেদনের ক্ষেত্রে এখন থেকে পেনশন, স্বীকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচ্যুইটি ফান্ড বাদে অন্য যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কাট অফ ডেটে পুঁজিবাজারে কমপক্ষে তিন কোটি টাকার বিনিয়োগ থাকতে হবে। আগে যেটা ছিল এক কোটি টাকা।

একইভাবে পেনশন ফান্ড, স্বীকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচ্যুইটি ফান্ডের ক্ষেত্রে আগে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল। সেটা বাড়িয়ে করা হয়েছে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে তারল্য বাড়ানোর লক্ষ্যে কমিশন সভা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানায় বিএসইসি।

তারল্য বাড়াতে বিএসইসি এমন পদক্ষেপ নিলেও ২৪ ও ২৫ মে শেয়ারবাজারে দরপতন হয়। এ পরিস্থিতিতে ২৫ মে সার্কিট ব্রেকারের নিয়মে পরিবর্তন এনে একদিনে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ দাম কমার নিয়ম বেঁধে দেয় বিএসইসি।

পরদিন ২৬ মে রাতে এক অনুষ্ঠানে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা আলাপ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী খুবই পজিটিভ। সবাই আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। শেয়ারবাজার নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। বর্তমানে বহির্বিশ্বের কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে। এটা সাময়িক। আপনারা ভয় পাবেন না। আশাকরি আগামী সপ্তাহে শেয়ারবাজারে ভালো কিছু হবে।

এরপর থেকেই টানা ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে শেয়ারবাজার। শেষ ছয় কার্যদিবসের টানা ঊর্ধ্বমুখিতায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ২৬৪ পয়েন্ট বেড়েছে।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও নিয়ে কাজ করেন এমন একটি ব্রোকারেজ হাউজের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বাজারের এই ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, নানা ইস্যুতে শেয়ারবাজারে এক ধরনের প্যানিক সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে ডলারের দাম নিয়ে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে যায়। তাদের সঙ্গে দেশি বড় বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার বিক্রি করে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে নিয়মিত যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বড় অঙ্কের লেনদেন হয়, তাদের লেনদেনের পরিমাণ কমে যায়। সবকিছু মিলে বাজারে বড় ধরনের দরপতন হয়।

তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিক্রির চাপ কমেছে। এসময় বিদেশিরা শেয়ার কিনেছেন। আবার বড় বিনিয়োগকারীরাও বাজারে সক্রিয় হয়েছেন, কিছু প্রতিষ্ঠানের লেনদেন চিত্র দেখে সেটা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। ফলস্বরূপ শেয়ারবাজারে টানা ঊর্ধ্বমুখী। তবে বাজার যে হারে পড়েছিল, সেই হারে ওঠেনি। অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার এখনো বেশ কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। বাজারের এ পরিস্থিতিকে কেনার উপযোগী বলা হয়।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, শেয়ারবাজারে নানা ইস্যুতে দরপতন হলেও এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় আছে। একদিকে বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে ডলারের দামের অস্থিরতার কারণে এবার শেয়ারবাজারে দরপতন হয়েছে। অতীতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে বাজারে বড় দরপতনের ঘটনা ঘটেছে। তবে অর্থমন্ত্রী এবার দরপতনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ আর্থিকখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করায় বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ধারাণা জন্মেছে এবার শেয়ারবাজারের ক্ষতি হয়, এমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক নেবে না।

‘অর্থমন্ত্রী আর্থিকখাতের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী প্রায় এক ঘণ্টা বিএসইসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছেন। একথা বিএসইসির চেয়ারম্যানে নিজেই জানিয়েছেন। এতে এখন সবাই বিশ্বাস করছেন, সরকার শেয়ারবাজার ভালো করতে চায়। এ কারণে বড় বিনিয়োগকারীরা আবারও বাজারে সক্রিয় হয়েছেন। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে।’

শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, বাজারে যে ধরনের কারেকশন (মূল্য সংশোধন) হয়েছে, তাতে ঘুরে দাঁড়ানোই স্বাভাবিক ছিল। আমি মনে করি এখনো বাজার কেনার জন্য যথেষ্ট উপযোগী। বিনিয়োগকারীদের এই বাজার থেকে ভালো প্রতিষ্ঠান বাছাই করে কেনা উচিত। তবে হুজুগে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না।

‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে হুটহাট সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা ঠিক নয়। দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হতে পারেন। তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সার্বিক পরিস্থিতি ভালো করে বিচার-বিশ্লেষণ করে নিতে হবে। বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে ছেড়ে দিতে হবে।’

ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারবাজার ভালো করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া টানা দরপতনের পর বাজারে অনেক মূল্য সংশোধন হয়েছে। গত কয়েকদিন ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও এখনো বাজারে কেনার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত। ভালো প্রতিষ্ঠান বাছাই করে কিনতে পারলে এই বাজার থেকে ভালো মুনাফা করা সম্ভব।

এমএএস/এএসএ/জেআইএম