ডিএসই কর্মকর্তাদের ‘অনৈতিক কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ
অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পাশাপাশি এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযানে নামায় তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
অভিযুক্ত ছয় কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন- ডিএসইর মহাব্যবস্থাপক (ডিএম) মো. সামিউল ইসলাম ও মো. আসাদুর রহমান। অন্য চারজান হলেন- উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. শফিকুর রহমান, মো. সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, সিনিয়র ম্যানেজার মো. রনি ইসলাম ও মো. পাঠান। এ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ৩০ জুনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আর দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ডিএসইর ডেপুটি ম্যানেজার মো. শাহাদত হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুদক। এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে তিনি ৫০ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জন করেছেন।
ডিএসইর এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক অনুসন্ধানী কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে এবং তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য দুদকের অনুসন্ধানী কর্মকর্তা নোটিশ জারি করেছেন। এ কারণে দুদকের নোটিশ গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে মো. শাহাদত হোসেনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে কমিশনকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠায় ডিএসই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিএসইসি তদন্তের নির্দেশ দিলেও এসব অভিযোগ অস্বীকার করছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তার সবই ‘ভিত্তিহীন ও মিথ্যা’।
বিএসই সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মো. সামিউল ইসলাম, মো. আসাদুর রহমান, মো. শফিকুর রহমান, মো. সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, মো. রনি ইসলাম ও মো. পাঠান এ ছয় কর্মকর্তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে চলতি বছরের ১০ এপ্রিল বিএসইসিতে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। ওই অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এরমধ্যে ডিএসইর জিএম মো. সামিউল ইসলামের বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি ২০০১ সালে তার পরিচিত লোকের কাছে তথ্যপাচার করেন। এজন্য তাকে সার্ভেইল্যান্স ডিপার্টমেন্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে অ্যাডমিনে থাকাকালীন তার এবং তার স্ত্রীর নামে হাউসে অ্যাকাউন্ট খুলে ব্যবসা করার অভিযোগ ওঠে। অফিস থেকে ডিএসই কর্মীদের ব্যবসায় যুক্ত থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা এলে এ দম্পতি নিজেদের নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো ক্লোজ করে বাসার কাজের বুয়ার নামে অ্যাকাউন্ট খুলে ব্যবসা চালিয়ে যায়। মূলত, অফিসের চোখে ধুলো দিতেই এমন কৌশল নেন তারা।
এরপর রাজধানীর নিকুঞ্জ এলাকায় নতুন অফিস নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়া হলে সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে সামিউল ইসলামের ওপর। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অফিসের রড চুরি করে স্ত্রীর নামে উত্তরায় একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেন তিনি। নিকুঞ্জে অফিসের কাজে বিমগুলোতে রড কম দেওয়া হয়েছে বলে জানালেও দ্রুতই এ অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে। নিধেষাজ্ঞা অমান্য করে ব্যবসা করা এবং অফিসের মালামাল চুরির দায়ে তাকেব অফিস থেকে বের করে দেওয়ার কথা উঠলেও শেষ পর্যন্ত কিছু প্রভাবশালী সদস্যের কারণে দাপটের সঙ্গে বহাল তবিয়তেই থেকে যান সামিউল।
এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, তিনি সাভারে একটি বেভারেজ লিমিটেড কোম্পানি করেছেন। বিভিন্ন হাউসে তার ব্যাপক ক্ষমতা, ব্যবসা তো রয়েছে। একইসঙ্গে ক্রেস্ট সিকিউরিটিস লিমিটেডের ৫০ শতাংশ শেয়ার তার। একজন চাকুরিজীবী হয়ে তিনি এত টাকা কোথায় পেলেন, তা জানতে তাকে দুদকে তলব করা হয়েছিল। কিন্তু এখানেও কথিত প্রভাবশালী সদস্যরা তাকে বাঁচিয়ে দেন। বর্তমানে ডিএসইর এ কর্মকর্তা অফিস এবং অফিসের বাইরে নারীসঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ডিএসইর অন্য এক জিএম মো. আসাদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি জিএম হওয়ার পর এমনই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন যে, নিজের বেতন দ্বিগুণ করে নিয়েছেন। যেখানে অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়নি। বর্তমানে তিনিও অফিস এবং অফিসের বাইরে নারীসঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
ডিজিএম মো. শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সামিউল ও আসাদুরের অপকর্ম কোনো অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশ হলে তখন তিনি (শফিকুর রহমান) সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সময়ে আর এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ না করার জন্য উৎকোচ হিসেবে টাকা দিতেন।
অন্য ডিজিএম মো. সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি লিস্টিং ডিপার্টমেন্টে থাকাকালীন রাহিমা ফুড নিয়ে জালিয়াতির প্রেক্ষিতে তার চাকরি হারানোর কথা। কিন্তু অদৃশ্য কোনো এক শক্তির প্রভাবে তাকে লিস্টিং থেকে মনিটরিং ডিপার্টমেন্টে স্থানান্তর করা হয়। এ ডিপার্টমেন্টে আসার পর ক্ষমতাধর সদস্যদের হাউসগুলো নামেমাত্র ইন্সপেকশন করা হতো। হাউসের নেগেটিভ ব্যালান্স থাকলেও তা পসিটিভ করে পাঠাতো বিএসইসিতে।
ডিএসইর সিনিয়র ম্যানেজার মো. রনি ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মেম্বারশিপ ডিপার্টমেন্টে থাকাবস্থায় হাউসে তার একটা ওয়ার্ক স্টেশন ছিল এবং হাউস বিক্রি ও অথোরাইজ নিয়োগে মানুষের কাছ থেকে তিনি টাকা নিতেন।
অন্য এক সিনিয়র ম্যানেজার মো. পাঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অ্যাকাউন্টসে থাকাবস্থায় এফডিআর এবং ডিপোজিট চেচের জন্য ক্লাইন্টের কাছ থেকে টাকা নিতেন। যা মারাত্মক ভায়োলেশন। অথচ প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে এ কর্মকর্তাও বহাল তবিয়তে থাকেন।
এসব অভিযোগ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মো. সামিউল ইসলাম জগো নিউজকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার সবগুলো মিথ্যা। কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে এমন অভিযোগ করেছেন আমি জানি না। আমার যদি এতোই সম্পদ থাকতো তাহলে তো আমি ডিএসইতে চাকরি করতাম না।
তিনি বলেন, আমিও চাই প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসুক। আমার এবং আমার ভাই-বোনদের নামে কী আছে তা খুঁজে বের করা হোক। একইসঙ্গে কারা এমন অভিযোগ করেছেন, তারও অনুসন্ধান হোক।
মো. আসাদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বিএসইসি থেকে কী ধরনের তদন্ত করতে বলা হয়েছে, তা এখনো আমি আনুষ্ঠানিকভাবে জানি না।
এসময় জাগো নিউজের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে- জিএম হওয়ার পর আপনি আপনার বেতন দ্বিগুণ করে নিয়েছেন এবং অফিস ও অফিসের বাইরে নারীসঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
এর উত্তরে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ সত্য না। আমি আমার বেতন বাড়ানোর বিষয়ে কখনো বোর্ডকে কোনো চিঠি দিইনি। বোর্ড থেকেই আমার বেতন বাড়ানো হয়েছে।
ডিজিএম মো. সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, আমি এমন কোনো অপরাধ করিনি, যাতে আমার চাকরি চলে যেতে পারে। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়।
এমএএস/এমকেআর/জিকেএস