ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

৬০ কোটি টাকায় রংপুরে আরএফএলের দ্বিতীয় বাইসাইকেল কারখানা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ১০:১২ এএম, ০৯ মে ২০২২

বড় হচ্ছে দেশের বাইসাইকেলের বাজার। প্রতিবছর বাড়ছে চাহিদা। এক যুগ আগেও এ খাত ছিল শতভাগ আমদানিনির্ভর। এখন স্থানীয় বাজারেই উৎপাদিত হচ্ছে মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ। রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপের বাজারে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি যার নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ আরএফএল। করোনাকালীন ও পরবর্তীসময়ে দেশ-বিদেশে বাইসাইকেলের চাহিদা আরও বেড়েছে। হবিগঞ্জ কারখানাকে রপ্তানিমুখী করে শুধু দেশের চাহিদা মেটাতে এবার তাই রংপুরের গঙ্গাচড়ায় বাইসাইকেলের দ্বিতীয় কারখানা স্থাপন করেছে আরএফএল। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য আগামী পাঁচ বছরে স্থানীয় সাইকেলের বাজারের ৮০ শতাংশ দখলে নেওয়া।

সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়ায় আরএফএল বাইসাইকেলের চালু হওয়া নতুন এ কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা তিন লাখ পিস। বর্তমানে চারশ জন কাজ করছেন। পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে গেলে কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ছয় লাখ পিস ও কর্মসংস্থান হবে প্রায় এক হাজার মানুষের। এ কারখানায় বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৬০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশে বাইসাইকেলের আনুমানিক চাহিদা বছরে ২০ লাখ পিস। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ আমদানি করা। দেশে প্রায় ১৮শ কোটি টাকার এই বাজারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশ। করোনায় স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি ও যানজটে নিরাপদ যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার বাড়ায় চাহিদা বেড়েছে আগের তুলনায় ২০ শতাংশ।

বাংলাদেশে বাইসাইকেল উৎপাদন করে আরএফএল ও মেঘনা গ্রুপ। ২০১৪ সালে ‘দুরন্ত’ নামে বাইসাইকেল বাজারজাত শুরু করে আরএফএল। খুব অল্প সময়ে দেশের বাজারে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় বাইসাইকেল ব্র্যান্ড ‘দুরন্ত’। বর্তমানে ট্রাই, কিডস, জুনিয়র, অ্যাডাল্ট, এমটিবি, লেডিস, ট্র্যাডিশনাল ও ই-বাইক ক্যাটাগরিতে নানা ধরনের সাইকেল রয়েছে। বর্তমানে চার হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে দুরন্ত বাইসাইকেল।
ব্র্যান্ডটির মার্কেট শেয়ার প্রায় ২০ শতাংশ। আরএফএল-এর বাইসাইকেল উৎপাদন ও বিপণনে বর্তমানে আড়াই হাজারের বেশি জনবল কর্মরত।

jagonews24রংপুরের গঙ্গচড়ায় আরএফএল এর নতুন বাইসাইকেল কারখানা

এতদিন হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ছিল আরএফএল-এর একমাত্র বাইসাইকেল কারখানাটি। এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা বছরে আট লাখ পিস। এই কারখানায় উৎপাদিত সাইকেল দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। তবে দেশ-বিদেশে আরএফএল বাইসাইকেলের চাহিদা বাড়ায় আমদানিনির্ভরতা কমাতে বিশেষ পরিকল্পনা নেয় আরএফএল। এরই অংশ হিসেবে হবিগঞ্জের পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চলে নতুন কারখানাটি চালু করা হয়েছে। এ কারখানাটি শুধু দেশের চাহিদা মেটাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আর এন পাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় আমাদের কারখানাগুলোয় প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখন প্রত্যন্ত এলাকায়ও কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করতে চায় আরএফএল। গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বও ঘুঁচবে।’

‘বর্তমানে গঙ্গাচড়ার নতুন বাইসাইকেল কারখানায় একশ জন নারী ও তিনশ জন পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কারখানাটি পুরোদমে চালু হলে আরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সব মিলিয়ে আরএফএল গ্রুপের বাইসাইকেল উৎপাদন ও বিপণনে আড়াই হাজার লোক কাজ করছেন।’

গঙ্গাচড়া লাইভ ইঞ্জিনিয়ার হাব হবে জানিয়ে আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, ‘এখানে শুধু কারখানা নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় আরও কিছু গড়ে উঠবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা থাকবে। অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে জমিও অধিগ্রহণ হবে। গঙ্গাচড়া একটা লাইভ ইঞ্জিনিয়ার হাব হবে।’

jagonews24বাজারে ছাড়ার জন্য প্রস্তুত দুরন্ত বাইসাইকেল

পরিবেশের দিকে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কারখানাটি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব। এখানে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) থাকবে। পরিবেশের সব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে কারখানাটি এগিয়ে যাবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা দেশীয় সাইকেলের বাজারের ৮০ শতাংশ দখল করতে চাই। বর্তমানে হবিগঞ্জে বছরে আট লাখ ও রংপুরের গঙ্গাচড়ার কারখানায় তিন লাখ সাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা আছে।’

বাইসাইকেল রপ্তানিতে আরএফএল
২০১৫ সালে ইংল্যান্ডে পাঠানোর মাধ্যমে আরএফএল বাইসাইকেলের রপ্তানি শুরু হয়। বর্তমানে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও বেলজিয়ামসহ ১০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ইংল্যান্ডের আরগোস, স্পোর্টসডিরেক্ট, টয়রাস্ ও ট্যানডেম, জার্মানির স্কুল এবং ডেনমার্কের এশিয়ান নরডিকের মতো প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ডগুলোর সাইকেল তৈরি করছি আরএফএল। বাইসাইকেলের পাশাপাশি ফ্রেম, ফর্ক, টায়ার, টিউবসহ সাইকেলের কিছু কম্পোনেন্টও রপ্তানি করা হচ্ছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৩ লাখ মার্কিন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক কোটি ২০ লাখ ডলার ও ২০২০-২১ অর্থবছরে এক কোটি ৮৮ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে আরএফএল। রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় পরপর দুবার (২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর) জাতীয় রপ্তানি ট্রফিও অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি।

রপ্তানিতে সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা
চীনে এন্টিডাম্পিং শুল্ক থাকায় ইউরোপের দেশগুলোর ক্রেতারা বর্তমানে কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম ও শ্রীলংকা থেকে সাইকেল কিনতে আগ্রহী। তবে অবকাঠামোগত দিক থেকে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এ খাতের রপ্তানি বাড়াতে পারে। তবে এজন্য প্রয়োজন সরকারের নীতিসহায়তা। রপ্তানিকারকদের জন্য বন্ড সুবিধার পাশাপাশি নগদ সহায়তা, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পুনরায় জিএসপি সুবিধা আদায় ও সম্ভাবনাময় দেশগুলোতে রপ্তানি বাড়াতে পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

jagonews24গঙ্গচড়ায় বাইসাইকেল কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা

বাংলাদেশে শুধু দুটি কোম্পানি সাইকেল উৎপাদন করছে। তবে এ খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে না ওঠায় এই শিল্প প্রসারে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ গড়ে উঠলে বর্তমানের তুলনায় অধিক সংখ্যক সাইকেল রপ্তানি করা যাবে। আমদানি করা কাঁচামাল সংকটের পাশাপাশি জাহাজ ভাড়াও অনেক বেশি। এগুলো সমাধান করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

এখনো যেহেতু ৬০ শতাংশ বাইসাইকেল আমদানি করা হয়, সেহেতু দেশে এ খাত বিকাশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে সরকারকে উৎপাদনকারীদের নানা ধরনের নীতিসহায়তা দিতে হবে। এ ধরনের সহায়তা দিলে যারা বর্তমানে বাইসাইকেল আমদানির সঙ্গে জড়িত তারাও দেশে বাইসাইকেল শিল্প স্থাপনে উৎসাহী হবেন।

আরএফএল বাইসাইকেল আমদানিনির্ভরতা কমাতে চায় জানিয়ে আর এন পাল বলেন, ‘দেশীয় চাহিদার ৬০ শতাংশ বাইসাইকেল এখনো আমদানি হয়। আমরা দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাইসাইকেল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে চাই। এতে একদিকে যেমন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে দেশীয় মুদ্রা সাশ্রয় হবে।’

আরএফএল-এর বাইসাইকেল বিশ্বের নামি-দামি স্টোরে পাওয়া যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, করোনা সংকটে ইউরোপ–আমেরিকার মতো উন্নত দেশে সাইকেলের চাহিদা বেড়েছে। মানুষ অনেক স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। চীনের সঙ্গে সমস্যা হওয়ায় বিকল্প বাজার খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। আমরা এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাই। এরই মধ্যে ওয়ালমার্টের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্ট ও যুক্তরাজ্যের আজদা স্টোরে আমাদের বাইসাইকেল বিক্রি হবে।’

কাঁচামাল
বাইক তৈরিতে যেসব কাঁচামাল প্রয়োজন হয় তার ৩০ শতাংশ চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা হয়। মূলত ট্রান্সমিশন (চেইন, হুইল) ও ব্রেকিং (ব্রেক) কম্পোনেন্ট আমদানি করা হয়। দুরন্ত বাইসাইকেলের কিছু কাঁচামাল (মেটাল শিট) জাপান থেকে এবং এক্সেসরিজ ভারত ও চীন থেকে আমদানি করা হয়। অন্যান্য কম্পোনেন্ট যেমন- ফ্রেম, ফর্ক, রিং, রিম, স্পোক, টায়ার ও টিউব আরএফএল-এর কারখানায় উৎপাদিত হয়।

মান নিয়ন্ত্রণ
মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কেমিক্যাল ও মেকানিক্যাল হাইটেক ল্যাব রয়েছে। এই টেস্টিং ল্যাবে সাইকেলের ফ্রেম ও ফর্কের ফ্যাটিগ টেস্ট করা হয়। এছাড়া চাকার লোড টেস্ট ও হ্যান্ডেল বারের ফ্যাটিগ টেস্ট এবং অন্যান্য উপকরণও টেস্ট করা হয়।

jagonews24গঙ্গচড়ায় আরএফএল-এর নতুন বাইসাইকেল কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকরা

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সংশ্লিষ্টরা জানান, আরএফএল আগামীতে ই-বাইকের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। নতুন কিছু ইলেকট্রিক বাইসাইকেল বাজারজাত করবে। বর্তমানে ১০টি দেশে রপ্তানি হয়। এ সংখ্যা আরও বাড়াতে কার্যক্রম চলমান। ২০২২ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সাইকেল রপ্তানির লক্ষ্যে কাজ করছে আরএফএল।

বাইসাইকেলের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন
স্থানীয় ও রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের সাইকেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে যন্ত্রাংশের চাহিদাও বাড়ছে। তবে এ খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি এখনো তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। এটি করতে সরকারকে নীতি সহায়তা দিতে হবে। এজন্য উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে কম সুদে ঋণ, আগ্রহী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্পমূল্যে জায়গা বরাদ্দ ও কারখানা স্থাপনে ট্যাক্স হলিডেসহ বিভিন্ন সুবিধা দিতে পারলে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠবে।

আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আর এন পাল আরও বলেন, ‘একসময় বিদেশ থেকে সম্পূর্ণ সাইকেল বা যন্ত্রাংশ এনে সংযোজন করে বাজারে ছাড়তেন এ দেশের ব্যবসায়ীরা। তবে সময় বদলেছে। বর্তমানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশেই বাইসাইকেল উৎপাদন করছে। দেশে বাইসাইকেলের বাজার প্রায় ১৮শ কোটি টাকার। দেশীয় চাহিদা মেটাতে চায় আরএফএল।’

এমওএস/এএসএ/জিকেএস