জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ
চলতি বছরে সার্বিক দ্রব্যমূল্য কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও অস্থির ছিলো নিত্যপণ্যের বাজার। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস পেলেও সুফল পায়নি দেশের মানুষ। অন্যদিকে, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে অতীতের মত স্বাস্থ্যখাতে সেবার মান ছিল ব্যয়বহুল ও প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে বেড়েই চলে জীবনযাত্রার ব্যয়; হিমশিম খান নিম্ন-মধ্যবিত্তরা।
বেসরকারি সংস্থা কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৫ প্রকাশ করেছে। ক্যাব বলছে, ২০১৫ সালে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
ক্যাব এর সংগৃহীত ঢাকা শহরের ১৫টি বাজার ও বিভিন্ন সেবা-সার্ভিসের মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা সার্ভিসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সদ্য সমাপ্ত ২০১৫ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে শতকরা ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ৪৪ পয়েন্ট কম। ২০১৪ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ছিল ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ।
ভোক্তার ঝুলিতে যেসব পণ্য ও সেবা রয়েছে সেসব পণ্য বা সেবা পরিবারের মোট ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে পণ্য বা সেবার ওজনের ভিত্তিতে জীবনযাত্রা ব্যয়ের এই হিসাব করা হয়। এই হিসাব শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াত ব্যয় বর্হিভূত।
ক্যাব সংগৃহীত ২০১৫ সালের পণ্যমূল্যের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের তুলনায় মাংশের দাম বেড়েছে ২৫ দশমিক ১০ শতাংশ, মসলার দাম বেড়েছে ২২ দশমিক ৫৩ শতাংশ, শাকসবজিতে বেড়েছে ১৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ডিমে বেড়েছে ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ, ডালে বেড়েছে ৮ দশমিক ০২ শতাংশ, ফলে বেড়েছে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ, পান-সুপারিতে বেড়েছে ৬ দশমিক ২৭ শতাংশ, গুড় ও চিনিতে বেড়েছে ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ, চা পাতায় বেড়েছে ১ দশমিক ০২ শতাংশ এবং নারিকেল তেলে বেড়েছে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
সারা বছরের পণ্যমূল্যে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশি ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচের মূল্য সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। দেশি পেঁয়াজ শতকরা ৭৬ দশমিক ১৭ শতাংশ ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ বেড়েছে ৭৪ দশমিক ০২ শতাংশ এবং কাঁচামরিচে বেড়েছে ২৯ দশমিক ৭১ শতাংশ।
২০১৫ গৃহস্থালিতে গ্যাসের মূল্য বেড়েছে শতকরা ৪৪ দশমিক ৪৪ ভাগ, বিদ্যুতের গড় দাম বেড়েছে গড়ে শতকরা ২ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং ওয়াসার পানি প্রতি হাজার লিটারে বেড়েছে ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। দেশি থান কাপড়ে দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, শাড়িতে বেড়েছে ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং গেঞ্জি তোয়ালে ও গামছায় বেড়েছে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ।
এ সময়ে সবচেয়ে বেশি দাম কমেছে ডালডা ও ঘি-তে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। আটা-ময়দায় কমেছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ, চালে ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, ভোজ্য তেলে ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ, সুগন্ধি চালে কমেছে ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ, গুঁড়ো দুধে কমেছে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং লবণে কমেছে ০ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
২০১৫ সালে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বাসা ভাড়া সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বস্তি এলাকায় ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ফ্ল্যাট বাসায় ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের মূল্য প্রায় ২০ শতাংশ বা অধিক হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বাজারে তার প্রভাব তেমন পড়েনি। ভোগ্য পণ্যের আমদানি গুটিকতক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করায় এবং তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে বাজার বিভাজনের অদৃশ্য সমঝোতার ফলে ভোক্তা সাধারণ বিশ্ববাজারে মূল্য হ্রাসের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন অব্যাহত থাকলেও এখন পর্যন্ত সরকার তা দেশের বাজারে সমন্বয় করেনি। অন্যদিকে, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সিএনজির দাম অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাস-মিনিবাস ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার ভাড়াও বর্ধিত করা হয়, তবে বাস্তবে বেড়েছে নির্ধারিত ভাড়ার অনেক বেশি।
অতীতের মতই স্বাস্থ্যখাতে সেবার মান ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ও ব্যয়বহুল। ডাক্তারের ফি ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট প্রদানের এবং মানহীন টেস্ট, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের অভিযোগ বরাবরের মতই উঠেছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে সবকারের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছে। ফরমালিনের ব্যবহারে হ্রাস টানা সম্ভব হলেও বাজারে নিম্নমান ও ভেজাল পণ্য অতীতের মতই বিক্রি হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। তবে ঝরে পড়ার হার এবং শিক্ষার মান এখনও দুশ্চিন্তার কারণ। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে বেতন ও নানা ধরনের ফি অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ অতীতের মতই অভিভাবকদের জন্য বাড়তি বোঝার কারণ ছিল। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বরাবরের মতই প্রশ্নবিদ্ধ থেকেছে।
দ্রব্যমূল্যে নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে বেশকিছু সুপারিশ করেছে ক্যাব। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ: আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য হ্রাসের সুফল ভোক্তা যাতে পেতে পারে সে লক্ষ্যে আমদানি বাণিজ্যকে অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক করার প্রযোজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে। প্রয়োজনে বাস্তবতার ভিত্তিতে টিসিবির মাধ্যমে ’লোকসান-নয়, লাভ-নয়’ ভিত্তিতে মানসম্পন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য নিয়মিত আমদানি ও বাজারজাতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা। গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের দাম সহনীয় মাত্রায় রাখাসহ আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় রেখে দেশীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনা।
২০০৭ সালে জারিকৃত পণ্যের মোড়কজাতকরণ বিধিমালা সম্পর্কে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের সচেতন করা ও এ বিধিমালা দেশব্যাপী কার্যকর করা। বর্তমান গণপরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো। পরিবহন সহজলভ্য করতে বাস, ট্যাক্সি-ক্যাব ও বেবি-ট্যাক্সির সংখ্যা বৃদ্ধি ও আইনের প্রয়োগ ও যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণের ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা।
পদ্মা সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার-লেন সড়ক, মেট্রোরেলসহ যোগাযোগ খাতের সকল প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা। যানজট নিরসন এবং যোগাযোগখাতে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করে পণ্য পরিবহন ব্যয় কমিয়ে আনা। শিক্ষা-চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালে রাখার উদ্যোগ নেয়া এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় দ্রুত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি চূড়ান্ত ও বাস্তবায়ন করা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এবং নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেয়া। আর্থিকখাতে বিশেষ করে ব্যাংকিংখাতকে অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত রাখার পদক্ষেপ জোরদার করা। ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা দ্রুততর করে সাধারণ নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা। কঠোর হস্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে দেশে স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখা।
এসআই/জেডএইচ/আরআইপি