কনটেইনার স্থানান্তরে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্কট কাটবে?
সরকারঘোষিত দেশব্যাপী চলমান লকডাউনে (বিধিনিষেধ) বন্ধ রয়েছে দেশের বেশিরভাগ শিল্পকারখানা। এতে করে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানিকৃত কনটেইনার খালাস প্রক্রিয়া আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ফলে বন্দরে বাড়তে থাকে কনটেইনারের সংখ্যা। সম্ভাব্য জট নিরসনে বেসরকারি ডিপোগুলোতে (আইসিডি) কনটেইনার স্থানান্তরের অনুমতি পায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনকে দ্রুত পণ্য খালাসের জন্য চাপ দেয়া হয়। আর এতে করে সৃষ্ট কনটেইনার জট সাময়িকভাবে কাটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিগগিরই পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানা খুলে না দিলে এতে বন্দরের জট নিরসনের সম্ভাবনা নেই। কারণ বর্তমানে ডিপোগুলোতে রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনারের চাপ রয়েছে। বন্দরের প্রাথমিক সঙ্কট নিরসনের জন্য আমদানি করা কনটেইনার কিছুদিনের জন্য রাখা যাবে। তবে সেখান থেকেও যদি ব্যবসায়ীরা কনটেইনার খালাস না করে তবেই জট হবে ভয়াবহ।
আবার ব্যবসায়ীরা বলছেন, কারখানা খোলা ছাড়া কনটেইনার খালাস করার তাদের তেমন বেশি সুযোগ নেই। কারণ বন্ধ কারখানায় কনটেইনার খালাস করে কী করবে- প্রশ্ন তাদের। তাছাড়া কারখানা বন্ধ থাকায় পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহনেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার মুখোমুখি হচ্ছে বলে অভিযোগ একাধিক ব্যবসায়ীর। আগস্টের শুরুতে যদি কারখানা খুলে দেয়া না হয় ব্যবসায়ীরা নানামুখী সঙ্কটের মুখোমুখি হবে। একদিকে বিদেশি ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। অন্যদিকে কারখানা চালু না হলে আর্থিক সঙ্কট তৈরি হবে।
ফলে শ্রমিকদের বেতনসহ কারখানার চলমান খরচ মেটানো সম্ভব হবে না। আবার আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের বড় খাত পোশাক কারখানা বাংলাদেশে বন্ধ থাকলেও প্রতিযোগী চীন, ভারত ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে চালু আছে। দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকলে স্থায়ীভাবে বিদেশি ক্রেতা হাতছাড়া হওয়ারও আশঙ্কা আছে। সবমিলিয়ে আগস্টের শুরুতে কারখানা খুলে না দিলে নানামুখী সঙ্কটে কনটেইনার খালাস প্রক্রিয়ায় ধীরগতি হবে। এতে করে বন্দরে তৈরি হবে কনটেইনার জট। ফলশ্রুতিতে ধস নামবে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, লকডাউনে জাহাজ থেকে আমদানিকৃত পণ্য খালাস প্রক্রিয়া ২৪ ঘণ্টাই চালু আছে। বিপরীতে আমদানিকারকেরা স্বাভাবিকের চার ভাগের একভাগের মতো কনটেইনার খালাস করছেন। বন্দর থেকে ২২ জুলাই ঈদের দিন ১২৮ টিইইউস, ২৩ জুলাই ৫৮২ টিইইউস, ২৪ জুলাই এক হাজার ১০ টিইইউস এবং ২৫ জুলাই সর্বশেষ পাওয়া খবর এক হাজার ৯০১ টিইইউস কনটেইনার খালাস হয়েছে। অর্থাৎ চারদিনে বন্দর থেকে খালাস হয়েছে তিন হাজার ৬২১ টিইইউস কনটেইনার। অথচ স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একদিনে গড়ে সাড়ে তিন হাজার টিইইউস কনটেইনার খালাস করে থাকেন আমদানিকারকেরা।
ফলে বন্দরের ভেতরে কনটেইনার জমতে থাকে। ২৫ জুলাই পর্যন্ত বন্দরে কনটেইনার জমা পড়েছে ৪৩ হাজার ৫৭৪ টিইইউস। যদিও বন্দরের ধারণক্ষমতা ৪৯ হাজার টিইইউস। তবে বন্দরের অপারেশনাল কাজে ৩০ শতাংশ জায়গা খালি রাখতে হয়।
এরই মধ্যে বন্দরের কনটেইনার খালাসের ধীরগতি ও সম্ভাব্য জট নিরসনে নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। গত শনিবার (২৪ জুলাই) নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে একটি চিঠি দেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। একই দিনে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত আরেকটি চিঠি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফ্রেট ফরোয়ার্ডস অ্যাসোসিয়েশন, বিকেএমইএ, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে ব্যবসায়ীদের দ্রুত কনটেইনার খালাস করতে তাগিদ দেয়া হয়।
এদিকে বন্দরের দেয়া চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আরেকটি চিঠিতে বন্দরে স্তূপ হওয়া কনটেইনার বেসরকারি ডিপোগুলোতে স্থানান্তরের অনুমতি প্রদান করে। রোববার (২৫ জুলাই) রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব (কাস্টমস নীতি) মেহরাজ-উল-আলম সম্রাট স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘কোডিড-১৯ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরে সৃষ্ট কনটেইনারজট নিরসনের লক্ষে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের পত্রের সুপারিশের আলোকে চট্টগ্রাম বন্দরে আগত সকল ধরনের পণ্যচালান সংশ্লিষ্ট কনটেইনার দুটি শর্তসাপেক্ষে চট্টগ্রামে অবস্থিত ১৯টি অফডকে (প্রাইভেট আইসিডি) সংরক্ষণ ও আনস্টাকিং করার এবং উক্ত অফডকসমূহ হতে খালাস প্রদানের অনুমতি প্রদান করা হলো।’
শর্তগুলো হচ্ছে- ১. অকডকসমূহে স্থানান্তরের সময় শতভাগ কনটেইনার আবশ্যিকভাবে স্ক্যানিং করতে হবে এবং স্ক্যানিংয়ের রিপোর্ট যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
২. অফডকে স্থানান্তরিত সকল কমার্শিয়াল পণ্যচালান আবশ্যিকভাবে চট্টগ্রাম কাস্টম এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের প্রতিনিধির সমন্বয়ে যৌথভাবে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে প্রাপ্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জানা গেছে, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে গত বছর প্রথম লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ওই সময়ও কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কারখানা বন্ধ হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট সৃষ্টি হয়। এরপর সঙ্কট নিরসনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে অনুমতি নিয়ে মে-জুন মাসে কনটেইনার ডিপোতে স্থানান্তর করে জট নিরসন করে বন্দর। এ বছর অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বন্দর বড় জট তৈরির আগেভাগে কনটেইনার স্থানান্তরের অনুমতি নেন।
এদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) হিসেব মতে, ১৯টি বেসরকারি ডিপোতে আমদানি, রফতানি ও খালি মিলিয়ে মোট ৭৭ হাজার টিইইউস কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। বিপরীতে রোববার (২৫ জুলাই) পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে মোট কনটেইনার রয়েছে ৫৩ হাজার ৮৬৪ টিইইউস। কিছুদিন আগে ডিপোগুলোতে রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনারের জট তৈরি হয়েছিল। সেই জট এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ডিপোগুলো।
ডিপোগুলোতে যেখানে রফতানি পণ্যবাহী স্বাভাবিক ৬ হাজার টিইইউস কনটেইনার থাকে সেখানে ১৯ হাজার পর্যন্ত জমা হয়েছিল। এরপর প্রতিদিন কয়েকটি বিশেষ জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করে বর্তমানে রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনারের সংখ্যা ১২ হাজার টিইইউসে নামিয়ে আনা হয়েছে। তারপরও স্বাভাবিকের প্রায় দ্বিগুণ রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনার ডিপোতে জমা রয়েছে। এ ছাড়াও বর্তমানে ডিপোগুলোতে আমদানিকৃত কনটেইনার রয়েছে ১০ হাজার ৭৬৬ টিইইউস এবং খালি কনটেইনার রয়েছে ৩০ হাজার ১২৪ টিইইউস।
বিকডা সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিপোগুলোতে বর্তমানে রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনারের চাপ রয়েছে। তারপরও দেশের স্বার্থে বন্দর সচল রাখতে ডিপোগুলোতে আমদানিকৃত কনটেইনার রাখা হবে। গত বছরও সৃষ্ট জট নিরসনে বন্দরের আমদানিকৃত কনটেইনার ডিপোতে রাখা হয়েছিল। ওই বছর আমরা প্রায় ৮০ হাজার টিইইউস আমদানিকৃত কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছি। এবারও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী কনটেইনার হ্যান্ডলিং করব। তবে ব্যবসায়ীরা যদি দ্রুত খালাস না করে তবে কয়েকদিন পর ডিপোতেও জট তৈরি হবে। তাছাড়া রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনারের দ্রুত পরিবহন করে কিছুটা খালি করা গেলে আমদানিকৃত কনটেইনার একটু বেশি রাখা যাবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্দরে প্রতিদিন জাহাজ থেকে পণ্যবাহী কনটেইনার খালাস হচ্ছে। বিপরীতে আমদানিকারকেরা কনটেইনার কম খালাস করায় বন্দরে কিছুটা জট তৈরি হয়েছিল। তবে অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার আগেই গত শনিবার বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনকে দ্রুত পণ্য খালাস করতে চিঠি পাঠানো হয়। একই দিন স্তূপ হওয়া কনটেইনার বেসরকারি ডিপোগুলোতে স্থানান্তরের অনুমতি চাওয়া হয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল (রোববার) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কনটেইনার বেসরকারি ডিপোগুলোতে স্থানান্তরের অনুমতি প্রদান করেন। এতে করে সাময়িকভাবে বন্দরের কনটেইনার জট নিরসন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার এম ফখরুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর জট নিরসনে আমদানিকৃত কনটেইনারের দুই মাসের জন্য ডিপোগুলোতে স্থানান্তর করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। ওই সময় আমরা কাজ করেছি। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবারও আন্তরিকতার সঙ্গে সর্বোচ্চ সেবা দেবে কাস্টম হাউস। ব্যবসায়ীরা দ্রুত পণ্য খালাসে সহযোগিতা করলে জট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।’
তবে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের কারখানা বন্ধ। কনটেইনার খালাস করে আমরা কোথায় রাখব? অন্যদিকে লকডাউনে কারখানা বন্ধ থাকায় আমাদের অনেক ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গতকাল (রোববার) আমাদের অনলাইন মিটিং হয়েছে। আজ (সোমবার) চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কাছে আংশিক কারখানা খুলে দেয়ার দাবি জানানো হবে। বন্দরের জট নিরসনে কারখানা খুলে দেয়ার বাস্তবতা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের জানানো হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগস্ট মাসের শুরুতে যদি কারখানা খুলে দেয়া না হয়, তবে কারখানাগুলো নানা জটিলতার মুখোমুখি হবে। ফলে বন্দর থেকে কনটেইনার খালাস প্রক্রিয়া কমে যাবে। এতে করে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ধস নামবে।’
বিজিএমইএ প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সচল রাখতে বন্দর কর্তৃপক্ষ কনটেইনার স্থানান্তরের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটির ক্ষেত্রে আমাদের দ্বিমত নেই। তবে কনটেইনার ডিপোতে স্থানান্তর করা হলে, আমাদের খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে এবং খালাসের প্রক্রিয়াও দীর্ঘ হবে। তাই বন্দরের কাছে আমাদের দাবি থাকবে- পোশাক কারখানার কনটেইনারগুলো বন্দর থেকে খালাসের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। এ জন্য সরকারের কাছে দাবি হলো আমাদের কারখানার আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অফিস করার ব্যবস্থা করে দেয়া অর্থাৎ আংশিক কারখানা খুলে দেয়া। তাহলে আমরা বন্দর থেকে মালামাল খালাস করতে পারবো। তবে আমাদের কারখানা যদি এভাবে বন্ধ থাকে আমরা বন্দর তো দূরে থাক ডিপো থেকেও মালামাল খালাস করতে পারবো কি-না সন্দেহ। ফলে বন্দর ও ডিপোতে জট তৈরি হবে। সবমিলিয়ে আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়া সচল রাখতে কারখানা খুলে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই।’
ইএ/এসএইচএস/জেআইএম