ভালো লভ্যাংশেও ব্যাংকে আগ্রহী হচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা
বছরের পর বছর ধরে লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দেয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর ২০২০ সালের ঘোষণা করা লভ্যাংশের চিত্র পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যাংকগুলো ভালো লভ্যাংশ দিলেও শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের খুব একটা আকৃষ্ট করতে পারছে না। ফলে অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বেশিরভাগ ব্যাংকের শেয়ার দাম।
ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে না পারার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বলছেন, ভালো লভ্যাংশ দিলেও সার্বিকভাবে ব্যাংক খাত সমস্যার মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আবার ঋণ বিতরণ খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। মুনাফার সক্ষমতাও কমে গেছে। এসব কারণে ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীরা খুব একটা আকৃষ্ট হচ্ছেন না।
তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, বিনিয়োগকারীরা যুক্তিসঙ্গত আচরণ করছেন না। যে কারণে ব্যাংকের শেয়ার এখন সবচেয়ে অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। লভ্যাংশের বিষয় বিবেচনায় নিলে এখন ব্যাংকের শেয়ারে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করেন না। তারা দ্রুত মুনাফা তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। এজন্য বুঝে না বুঝে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেন।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১৫টি ২০২০ সালের সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ১০টিই ২০১৯ সালের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে নয়টিই গত বছরের চেয়ে বেশি নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এছাড়া গত বছরের চেয়ে কিছু কম লভ্যাংশ ঘোষণা করা একটি ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
অপরদিকে ব্যাংক এশিয়া ২০১৯ সালের মতো ২০২০ সালেও ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে দু’টি ব্যাংকের লভ্যাংশ গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। আর বরাবরের মতো কোনো ধরনের লভ্যাংশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমস্যার মধ্যে থাকা আইসিবি ইসলামী ব্যাংক।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১০ সালের মহাধসের পর শেয়ারবাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ব্যাংক খাতের দুরবস্থা। একের পর এক ব্যাংকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ হিসেবে মাত্রারিক্ত বোনাস শেয়ার দিয়েছে। এতে একদিকে ব্যাংকের শেয়ার সংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার সক্ষমতা কমেছে। যে কারণে কয়েক বছর ধরে বেশিরভাগ ব্যাংক লভ্যাংশের ক্ষেত্রে অনেকটাই বোনাস শেয়ার নির্ভর হয়ে পড়েছে।
তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো লভ্যাংশের ক্ষেত্রে বোনাস শেয়ার নির্ভর হয়ে পড়ায় বিনিয়োগকারীরা বাস্তবে খুব একটা লাভবান হননি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শেয়ারের মূল্যে। ফলে অনেক ব্যাংকের শেয়ার এখন নামমাত্র দামে বিক্রি হচ্ছে। তালিকাভুক্ত ৩১টি ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটির শেয়ার দাম ফেস ভ্যালু বা ১০ টাকার নিচে অবস্থান করছে। আরও আটটি ব্যাংকের শেয়ার দাম ফেস ভ্যালুর কাছাকাছি অবস্থান করছে। শেয়ারের দাম ২০ টাকা বা তার বেশি আছে মাত্র ১০টির। ব্যাংকের শেয়ারের এই চিত্র শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালের জন্য কম লভ্যাংশ ঘোষণা করা ব্যাংক দুটির মধ্যে রয়েছে আইএফআইসি এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংক। এর মধ্যে আইএফআইসি বরাবরের মতো শুধু বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২০ সালের জন্য ব্যাংকটি শেয়ারহোল্ডারদের ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে ২০১৯ ও ২০১৮ সালে ১০ শতাংশ করে এবং ২০১৭ ও ২০১৬ সালে ১২ শতাংশ করে বোনাস শেয়ার দেয় এই ব্যাংক। এ হিসাবে বোনাস শেয়ার নির্ভরশীল হওয়ার পরও ব্যাংকটির লভ্যাংশের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমে গেছে।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২০২০ সালের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগের বছর ২০১৯ সালে ব্যাংকটি ১১ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০১৮ সালে ১৫ শতাংশ বোনাস, ২০১৭ সালে ১৭ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস এবং ২০১৬ সালে ১৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয় এই ব্যাংক।
অন্যদিকে ২০২০ সালের জন্য সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে ইস্টার্ন ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশের পাশাপাশি সাড়ে ১৭ শতাংশ বোনাস শেয়ারও লভ্যাংশ হিসেবে দেবে। আগের বছর ২০১৯ সালে ব্যাংকটি শুধু ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় ব্যাংকটির নগদ লভ্যাংশ বাড়ার পাশাপাশি মোট লভ্যাংশ বেড়ে দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে।
তার আগে ২০১৮ সালে ২০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বেনাস শেয়ার, ২০১৭ সালে ২০ শতাংশ নগদ এবং ২০১৬ সালে ২০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকটি। সে হিসাবে গত পাঁচ বছরের মধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংক এবার সর্বোচ্চ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।
সর্বোচ্চ লভ্যাংশ ঘোষণার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি ১৫ শতাংশ নগদের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০১৯ সালে ব্যাংকটি শেয়ারহোল্ডারদের ১৫ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০১৮ সালে ১৫০ শতাংশ বোনাস, ২০১৭ ও ২০১৬ সালে ৩০ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয় এই ব্যাংকটি।
এছাড়া আরও কিছু ব্যাংক আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে লভ্যাংশ বাড়িয়েছে। সেগুলো হলো ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংক।
লভ্যাংশ বাড়া ব্যাংকগুলোর চিত্র-
ব্যাংকের নাম |
লভ্যাংশ |
||||
২০২০ |
২০১৯ |
২০১৮ |
২০১৭ |
২০১৬ |
|
ব্র্যাক ব্যাংক |
১০ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
৭.৫ শতাংশ নগদ এবং ৭.৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১৫ শতাংশ নগদ |
২৫ শতাংশ নগদ |
১০ শতাংশ নগদ এবং ২০ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
সিটি ব্যাংক |
১৭.৭ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১৫ শতাংশ নগদ |
৬ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১৯ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
২৪ শতাংশ নগদ |
যমুনা ব্যাংক |
১৭.৫ শতাংশ নগদ |
১৫ শতাংশ নগদ |
২০ শতাংশ নগদ |
২২ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
২০.৫ শতাংশ নগদ |
ওয়ান ব্যাংক |
৬ শতাংশ নগদ এবং ৫.৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১৩ শতাংশ নগদ এবং ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
প্রিমিয়ার ব্যাংক |
১২.৫ শতাংশ নগদ এবং ৭.৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১৫.৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১০ শতাংশ নগদ এবং ২ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
প্রাইম ব্যাংক |
১৫ শতাংশ নগদ |
১৩.৫ শতাংশ নগদ |
১২.৫ শতাংশ নগদ |
৭ শতাংশ নগদ এবং ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১৬ শতাংশ নগদ |
পূবালী ব্যাংক |
১২.৫ শতাংশ নগদ |
১০ শতাংশ নগদ |
১০ শতাংশ নগদ এবং ৩ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
৫ শতাংশ নগদ এবং ৮ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক |
৭ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
১০ শতাংশ নগদ |
উত্তরা ব্যাংক |
১২.৫ শতাংশ নগদ এবং ১২.৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
৭ শতাংশ নগদ এবং ২৩ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
২০ শতাংশ নগদ এবং ২ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
২০ শতাংশ নগদ |
২০ শতাংশ নগদ |
সার্বিক বিষয়ে একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের লভ্যাংশের সর্বোচ্চ সীমা সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদসহ মোট ৩৫ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছে। এছাড়া লভ্যাংশের ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। এসব শর্ত জুড়ে না দিলে ২০২০ সালে ব্যাংকের লভ্যাংশের পরিমাণ আরও বাড়ত।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর শেয়ারবাজার ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে না পারার মূল কারণ ব্যাংক খাত। ব্যাংকের অনেক পরিচালক উচ্চ দামে বাজারে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন দাম কমার পরও তারা সেই শেয়ার কিনছেন না। যে কারণে এখন ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা পরও ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। যদি শেয়ারবাজারে ব্যাংক ভালো করতো তাহলে সূচক অনেক বেড়ে যেত এবং বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ত।
তিনি বলেন, লভ্যাংশ ঘোষণার পর ব্যাংকের শেয়ার একটু বাড়লেও রেকর্ড ডেটের পর আবার দাম কমে যাচ্ছে। তার মানে হলো ব্যাংকের প্রতি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। ব্যাংকের শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে রেখে ভালো বেনিফিট পাওয়া যাবে কি-না তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংশয় আছে। কারণ নানা ছাড়ের কারণে এখন ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে। এটা সামনে থাকবে কি-না তা নিয়ে সংশয় আছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, লভ্যাংশের পরিমাণ বাড়লেও সার্বিকভাবে ব্যাংক খাত এখনো সমস্যার মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকের প্রফিট অ্যাবিলিটি (মুনাফার সক্ষমতা) কমে গেছে। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণ বিতরণের হারও খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। এসব কারণে ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীরা খুব একটা আকৃষ্ট হচ্ছেন না।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, লভ্যাংশের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বর্তমানে ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগের জন্য সব চেয়ে বেশি উপযুক্ত। কিন্তু ভালো লভ্যাংশ দেয়ার পরও ব্যাংকের শেয়ার দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এর কারণ আমাদের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করেন না।
এমএএস/এইচএ/এমকেএইচ