‘মহামারিতেও অর্থনীতি সঠিক পথে, সামনে চ্যালেঞ্জ’
করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে রয়েছে। তবে সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয় প্রয়োজন। মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক ওয়েবিনারের অংশগ্রহকারীরা এমন অভিমত দেন।
ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমানের সভাপতিত্বে এই ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এবং পলিসি এক্সচেঞ্জ-এর চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ এতে বিশেষ আলোচক হিসেবে অংশ নেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মসিউর রহমান বলেন, বর্তমান সময়ের বিবেচনায় জাতীয় সঞ্চয়ের কার্যকর ব্যবহার এবং একই সঙ্গে অর্থনীতিতে অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, সরকার করোনা পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করেছে এবং এ লক্ষ্যে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও সময়োপযোগী বাস্তবায়নের ফলে দেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই পরিচালিত হচ্ছে। সরকার দেশের কৃষি খাতের আধুনিকায়ন, সমাজের অতিদরিদ্র এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে বেশি মাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেলেও, যেসব দেশে আমাদের প্রবাসীরা বেশি হারে নিয়োজিত রয়েছেন, সেখান থেকে প্রবাসীরা ফেরত আসলে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে সকলকে সচেতন থাকাতে তবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, করোনার কারণে আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। তবে করোনা মোকাবিলায় সরকারের নেতৃত্ব সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাস্তবতায় নিরিখেই সরকার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে।
তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থায় ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হলেও আমাদের অবস্থান ভালো থাকবে। তবে এ অবস্থা উত্তরণে প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ, প্রয়োজনীয় নীতিমালার সহজীকরণ এবং ঘোষিত নীতিমালায় এ মুহূর্তে কোনো ধরনের পরিবর্তন উচিত নয়।
অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থনীতির ওপর আরও বেশি হারে গুরুত্বারোপের আহ্বান জানিয়ে ড. আতিউর আরও বলেন, কৃষি ও এমএসএমই খাতকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ডিজিটাল ব্যবস্থার বাস্তাবায়নের মাধ্যমে সকলকে করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তি খাতকে আরও বেশি সহায়তা করা প্রয়োজন। এ জন্য উদ্যোক্তাদের নীতিসহায়তা প্রদানের পাশপাশি নজরদারি বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে নীতিসহায়তার পাশাপাশি অর্থ সহযোগিতা করতে হবে। সবুজ অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়নে ওপর আরও বেশি গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রমে বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে। সর্বোপরি স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং মানব সম্পদ উন্নয়নে আরও বেশি হারে বিনিয়োগ করতে হবে।
পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে আমরা বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হইনি। তবে ভবিষ্যতের যাত্রাপথের প্রস্তুতি এখনই গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা বাড়ানো এবং দারিদ্র বিমোচন প্রক্রিয়ায় আরও নজর দিতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরি আনতে প্রয়োজনীয় সংষ্কারের পাশাপাশি নীতিসহায়তা দিতে হবে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগ কেন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছে না, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। গ্রামাঞ্চলের মানুষজন ও বস্তিবাসীসহ সকলকে টিকা গ্রহণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। চামড়া খাতের উন্নয়নে সাভার ট্যনারি পল্লীতে ইটিপি বাস্তবায়নের কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে করা প্রয়োজন। এসএমই খাতের উন্নয়নে কৃষি ব্যাংকের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যমান অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। রাজস্ব আহরণে মাত্রা বাড়ানোর জন্য সকলকে করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ-এর চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, করোনার সময়ে আমাদের কৃষিখাত সচল ছিল এবং সরকারের সহযোগিতা অব্যাহত থাকায় আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। গত জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের রফতানি ১ শতাংশ কমেছে, তবে স্থানীয় চাহিদা এবং ক্রেডিট কার্ড এবং ব্যাংক হতে কনজুমরার লোন গ্রহণের হার বেড়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের রফতানি পণ্যের সম্ভাবনাময় বাজারের দেশগুলোর কোভিড থেকে বের হতে আরও বেশকিছু সময় লাগবে। তাই রফতানি নিয়ে আমাদের আরও বেশি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতিমালাকে যুগোপযোগী করতে হবে। বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সম্ভাবনাময় দেশগুলোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং তার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
ওয়েবিনারের মূল প্রবন্ধে ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির নানামুখী প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও গত ৬ মাসে দেশের অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পরিচালিত হয়েছে। তবে আমাদের বেসরকারি খাতের উন্নয়নে আরও বেশকিছু কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদশের জিডিপি ৩৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উন্নীত হলেও ওই সময়ে জিডিপি’র লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৪৩.৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
রাজস্ব খাতে দ্রুততার সঙ্গে অটোমেশন প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাস্তবায়ন এবং অর্থবছরের ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে কোভিড মহামারি মোকাবিলায় ঘোষিত বাজেট কার্যক্রমের পর্যালোচনা এবং বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যবহরের অগ্রগতি মূল্যায়নের ওপর জোর দেন ডিসিসিআই সভাপতি।
তিনি বলেন, মহামারি মোকাবিলায় এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুততার সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে এসএমই ব্যাংক প্রবর্তন, সিএসএমইখাতের সংজ্ঞা পুনর্নিধারণ ও এসএমই উদ্যোক্তাদের ডাটাবেজ প্রস্তুতকরণে জোর দিতে হবে।
ডিসিসিআই সভাপতি দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং বেসরকারি খাতকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আর্কষণ এবং ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় হ্রাসে বিশেষ করে সমুদ্রবন্দরসহ সকল বন্দরের দক্ষতা উন্নয়ন করা প্রয়োজন।
এমএএস/এএএইচ/এএসএম