করোনার আঘাতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় ধস
করোনাভাইরাসের আঘাতে কমে এসেছে বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। এর ফলে বছর জুড়েই ব্যাংকগুলোকে মহামারির চড়া মাশুল দিতে হয়েছে।
অন্যদিকে ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে থেকেই খেলাপি ঋণের চাপ, তারল্য সংকটের পাশাপাশি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতি হওয়ায় পরিচালন মুনাফা কমেছে উল্লেখযোগ্যহারে।
ব্যাংকাররা বলছেন, গত এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কে (৯ শতাংশ) নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আর খেলাপি না হওয়া বা অশ্রেণিকৃত ভালো মানের ঋণে খাতভেদে সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হয় দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত। সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতির বাইরে নতুন করে আরও এক শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে নিট মুনাফার ক্ষেত্রে চাপে পড়ছে ব্যাংকগুলো। কারণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা থেকে।
দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। প্রান্তিক (তিন মাস) ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো তাদের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে জমা দেয়। তার আগে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সভায় এ আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করতে হয়। পরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সে তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।
তবে নিয়ম অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে জমার দেয়ার আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব তথ্য জানাতে পারবে না। তবে বিভিন্ন সূত্রে বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য পাওয়া যায়, যেখানে বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমে গেছে।
ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ শেষে পূবালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা এক হাজার ২৫ কোটি থেকে ৯৩৫ কোটিতে এসে পৌঁছেছে। বছর শেষে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের মুনাফা হয়েছে ৮৫০ কোটি। ২০১৯ সাল শেষে যার পরিমাণ ছিল ৯০০ কোটি টাকা। আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৭১০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের মুনাফা ছিল ৮০১ কোটি। এক্সিম ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৭৪১ কোটি যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ কোটি টাকা কম।
২০২০ শেষে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৭৭০ কোটি টাকা। যা গত বছরের তুলনায় ২৯০ কোটি টাকা কম। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল এক হাজার ৬০ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংকের ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ৭৩০ কোটি থেকে ৬৪০ কোটিতে নেমে এসেছে।
সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের মুনাফা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫২ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ২৪৬ কোটি টাকা। এই সময়ে মেঘনা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা নেমে এসেছে শতকোটি টাকার নিচে। গত বছর মেঘনার পরিচালন মুনাফা ছিল ১২৪ কোটি। কিন্তু ২০২০ শেষে ব্যাংকের মুনাফা নেমে এসেছে ৮৫ কোটি টাকায়।
বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমে গেলেও ২০২০ শেষে কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। মুনাফা বৃদ্ধি পাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক, এনআরবিসি ও মধুমতি ব্যাংক অন্যতম।
বছর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়ে এক হাজার ১৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। তবে গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ৯৪৮ কোটি টাকা। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২৬৫ কোটি থেকে ৩২৩ কোটিতে পৌঁছেছে। এছাড়া মধুমতি ব্যাংকের ২০২০ সালের পরিচালন মুনাফা ২৭৮ কোটি। তবে গত বছর এই মুনাফার পরিমাণ ছিল ২১০ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুদহার কমায় এমনিতেই ব্যাংকের মুনাফা কমে গেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত ও নতুন করে কেউ খেলাপি না হওয়ায় ব্যাংকের মুনাফা বাড়তে শুরু করেছিল। এখন নতুন করে এক শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হলে ব্যাংকের নিট মুনাফায় বড় ধাক্কা আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা কার্যকর করতে হলে নতুন করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এতে অনেক ব্যাংক লোকসানে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তবে ব্যাংকের মুনাফা কমে গেলে বা লোকসানে চলে গেলে তার বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে শেয়ারবাজারেও। কারণ শেয়ারবাজারের সূচক ও বাজার মূলধনে ব্যাংক খাতের প্রভাবই বেশি।
ইএআর/এআরএ