রিজার্ভ থেকে ঋণ নিতে চায় সরকার, হচ্ছে নীতিমালা
>> রূপরেখা তৈরি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠি
>> বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক
>> সিদ্ধান্ত গ্রহণে করোনায় প্রবাসীদের ফিরে আসার বিষয়টি ভাবাচ্ছে
বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি অংশ সরকারি খাতে গৃহীত লাভজনক প্রকল্পে ঋণ হিসেবে অর্থায়ন সম্ভব কি-না, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একই ধরনের নির্দেশনার পর সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি লিখে এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠন করে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়া যেতে পারে। তবে রিজার্ভ খরচ এবং ঋণের প্রকল্প নির্ধারণ দুই ক্ষেত্রেই সতর্ক থাকার পরামর্শ তাদের।
গভর্নরকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি অংশ সরকারি খাতে গৃহীত লাভজনক প্রকল্পে ঋণ হিসেবে অর্থায়ন সম্ভব কি-না, এ বিষয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি রূপরেখা বা নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ কতে হবে। এ বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এটা নিয়ে চিন্তা করতে পারে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক তা পর্যালোচনা করছে।’
তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ থাকে সেটা সাধারণত তিন মাসের বৈদেশিক মুদ্রার দায় মেটানোর জন্য মজুত থাকতে হয়। করোনার প্রভাবে আপাতত আমদানি-রফতানি উভয়ই কম। এজন্য রিজার্ভের ফিগারটা বেশ বড় দেখা যাচ্ছে । কিন্তু এ মহামারিটা কমে গেলে তখন কী হবে সে বিষয়েও যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ মুখপাত্র আরও বলেন, ‘করোনার কারণে অনেক প্রবাসী দেশে চলে এসেছেন। এর ফলে আমাদের বৈদেশি মুদ্রায় কী ধরনের প্রভাব পড়বে, সেসব বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রিজার্ভকে সামনে রেখেই বিভিন্ন ধরনের ঋণ দিয়ে থাকে। এজন্য হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না।’
রফতানি, রেমিট্যান্স, বিদেশি বিনিয়োগে কোনো দেশে যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত তৈরি হয়, তাই রিজার্ভ। এই ভান্ডার থেকে আমদানি ব্যয় মেটানো হয়। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, সাধারণত কোনো দেশের তিন মাসের বৈদেশিক মুদ্রার দায় মেটানোর মতো মজুত থাকতে হয়। এর কম থাকলে ঝুঁকি হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশে গত এক দশকে রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে গত ৩ আগস্ট ৩৭ বিলিয়ন (৩ হাজার ৭০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রায় এক বছরের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
নানা টানাপোড়েনে পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন না আসার পর এর বিশাল নির্মাণ ব্যয় মেটাতে ২০১৫ সালে রিজার্ভ থেকে ঋণ নেয়ার কথা ভেবেছিল সরকার। তখন কিছু প্রক্রিয়া শুরু হলেও ২০১৬ সালের মার্চে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ডলার চুরি হওয়ার পর রিজার্ভ থেকে আর ঋণ নেয়া হয়নি।
এ বিষয় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের যে রিজার্ভ আছে, তা এক অর্থে অলসই পড়ে থাকছে। এখান থেকে সরকার যদি কিছু অর্থ ঋণ হিসেবে ব্যবহার করে তাহলে ক্ষতির কিছু নেই। তবে, সুদের হার ও পরিশোধের মেয়াদ কী হবে, কোন ধরনের প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে, তা আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে।’
দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করে আসা অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে পাঁচ-সাত বিলিয়ন ডলার নিয়ে এই তহবিল গঠন করা যেতে পারে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা পূরণে এ তহবিলের অর্থ খরচ করতে পারে সরকার।’
পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাই, তহবিলের কার্যপদ্ধতি এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এর সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার দিকগুলো পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটিতেও ছিলেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, তখন আমরা পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সভরেন ওয়েলথ ফান্ড গঠনের সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু সেটা কেন করা হলো না, বুঝতে পারলাম না।’
ড. আহসান মনসুর আরও বলেন, মহামারীকালে এখন আমদানি ব্যয় কম মেটাতে হলেও কিছু দিন পর পরিস্থিতি বদলেও যেতে পারে, তা-ও ভাবতে হবে। ৩৬-৩৭ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কিন্তু খুব বেশি নয়। এখন আমদানি খাতে কম খরচ হচ্ছে ঠিক। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমদানি ব্যয় বাড়বে, তখন এই রিজার্ভ খুবই মূল্যবান হয়ে উঠবে। তাই সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়াতে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ৬ জুলাই একনেকের সভায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ঋণ নেয়া কিংবা এই অর্থ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবহার করা যায় কি-না, সে বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওই সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা বিদেশিদের কাছ থেকে ডলারে ঋণ নিই। আমাদের রিজার্ভ এখন ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এখান থেকে আমরা ঋণ নিতে পারি কি-না? বাংলাদেশ ব্যাংক জনগণের পক্ষে এই টাকা সংরক্ষণ করে। ওখান থেকে আমরা প্রকল্পের জন্য ঋণ নিতে পারি। বিদেশ থেকে আমরা যে সুদে ঋণ আনি তা একটু কম হলেও দেশের টাকা ব্যবহার করলে লাভটা দেশেই থাকবে।’
এমইউএইচ/এসআর/জেআইএম