কোন কোন পণ্যে চীনের শুল্কমুক্ত সুবিধা, জানা নেই কারও!
বৈশ্বিক করোনাভাইরাস (কোভিড- ১৯) মহামারিতে রফতানি পণ্যের বাজার যখন সংকুচিত হয়ে আসছিল ঠিক তখন চীনের বাজারে আরও পাঁচ হাজার ১৬১টি পণ্যে ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। গত ১৬ জুন মোট আট হাজার ২৫৬টি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার ঘোষণা দেয় চীন সরকার। গত ১ জুলাই থেকে এ সুবিধা কার্যকরও হয়েছে।
চীনের দেয়া এমন সুবিধা কাজে লাগাতে পারলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের জন্য নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে, পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত আরও মজবুত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কিন্তু চীনের দেয়া সুবিধা কার্যকরের এক মাস সময় পার হলেও নতুন করে কোন কোন পণ্যের ওপর এ সুবিধা দেয়া হয়েছে তা সরকার, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক বা ব্যবসায়ীরা কেউ জানেন না। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত এসব পণ্যের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকাও কারও হাতে পৌঁছেনি। ফলে বাংলাদেশ কোন ধরনের পণ্যে চীনের প্রদত্ত সুবিধা ভোগ করবে— সেটা কারও জানা নেই। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-কে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেয়। চিঠিটি রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোতেও পাঠানো হয়েছে।
সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “দীর্ঘ নেগোসিয়েশনের পর গত ১৬ জুন চীন বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে অর্থাৎ আট হাজার ২৫৬টি পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা প্রদান করেছে। যা ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। চীন প্রদত্ত শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত পণ্যের তালিকা ‘Import and Export Tariff of People's Republic of China, 2020’ -এর http://gss.mof.gov.cn ওয়েব লিংকে পাওয়া যাবে।’’
‘চীনের বাজারে ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্য রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা প্রদানের বিষয়টি আপনার সংগঠনের সকল সদস্যকে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
ওই লিংকে আট হাজার ২৫৬টি পণ্যের তালিকা দেয়া আছে। কিন্তু সেগুলো চীনা ভাষায়। তাই এ তালিকা নিয়ে কোনো কাজ করতে পারেনি ইপিবি। এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবসায়ী শুল্কমুক্ত সুবিধা নিতে পারেননি। কোন কোন ধরনের পণ্যে তারা সুবিধা পাবেন, তাও জানতে পরেননি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগে থেকেই এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা আপটার আওতায় তিন হাজার ৯৫টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করে আসছে বাংলাদেশ। গত ১৬ জুন আরও পাঁচ হাজার ১৬১টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন, তাতে তৈরি পোশাক আছে। সবমিলিয়ে আট হাজার ২৫৬টি পণ্যে অর্থাৎ ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে চীন সরকার।
চীন সরকার যেসব পণ্যে নতুনভাবে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিল তার কোনো তালিকা রয়েছে কি-না, জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) শরিফা খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হ্যাঁ, তালিকা রয়েছে। সে তালিকা ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনেও দেয়া হয়েছে।’
যে তালিকা দেয়া হয়েছে সেটি তো চীনা ভাষায়, তাই কেউ কিছু বুঝতে পারছেন না। এমনকি ইপিবিও এটা নিয়ে কোনো কাজ করতে পারছে না— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শরিফা খান বলেন, ‘এতগুলো পণ্যের বাংলা করা সম্ভব হয়নি। তবে যে ৩ শতাংশ পণ্য এ সুবিধার বাইরে রয়েছে সেগুলোর বাংলা করা হয়েছে।’
চীনের প্রদত্ত সুবিধায় বাংলাদেশের কোন কোন পণ্য রফতানি করা সম্ভব হবে— এমন প্রশ্ন করা হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রফতানি) মো. ওবায়দুল আজম বলেন, বিষয়টি নিয়ে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কাজ করছে। আপনারা ওখানে খোঁজ নিলে সব পাবেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইপিবি’র ভাইস-চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘চীন আমাদের ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। ফলে আমরা যেসব পণ্য রফতানি করি তার সবগুলো এখন এ সুবিধার আওতায় পড়বে। সুতরাং রফতানিকারকরা এখন যা রফতানি করতে চাইবেন প্রদত্ত সুবিধার আওতায় তাই পড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমাদের রফতানির সক্ষমতা হচ্ছে তৈরি পোশাকে। তৈরি পোশাকের অনেক পণ্যে আমরা ইতোমধ্যে এ সুবিধা পেতাম। এখন সব পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আসল।’
ইপিবি’র ভাইস-চেয়ারম্যান বলেন, ‘নতুন সুবিধায় আমরা আরও ১৫ থেকে ১৭টি পণ্যে ভালো করতে পারব। এসব পণ্যের একটা তালিকাও করা হয়েছে।’ তবে এসব পণ্যের একটিরও নাম বলতে পারেননি তিনি। এ বিষয়ে ইপিবি’র নীতি ও পরিকল্পনা এবং পণ্য বিভাগে যোগাযোগ করতে বলেন এ এইচ এম আহসান।
ইপিবি’র নীতি ও পরিকল্পনা শাখার উপ-পরিচালক বেগম কুমকুম সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ধরনের ১৫ থেকে ১৭টি পণ্যের কোনো তালিকা আমাদের কাছে নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে মোট আট হাজার ২৫৬টি পণ্যের যে তালিকা দেয়া হয়েছে সেটি চীনা ভাষায়, কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। এ নিয়ে আমরা দেশটির দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।’
ইপিবি’র পণ্য শাখার উপ-পরিচালক মো. শাহজালাল বলেন, ‘এ ধরনের কোনো কিছু থাকলে নীতি ও পরিকল্পনা শাখায় রয়েছে। আমাদের কাছে কিছু নেই। এমনকি আট হাজার ২৫৬টি পণ্যের যে তালিকা সেটিও আমরা পায়নি।’
বিষয়টি নিয়ে আবারও ইপিবি’র ভাইস-চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার একান্ত সচিব (পিএস) বলেন, ‘এটি যদি নীতি ও পরিকল্পনা এবং পণ্য শাখায় না থাকে তাহলে এ ধরনের কোনো তালিকা মনে হয় নাই।’ তারপরও ভাইস-চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আর কথা বলা সম্ভব হয়নি। ঈদের পর যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।
পোশাক রফতানিকারকরা চীন প্রদত্ত কোনো সুবিধা পাচ্ছে কি-না, জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএ’র এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, নতুনভাবে যে শুল্ক সুবিধা দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে অধিকাংশ ব্যবসায়ী কিছুই জানেন না। এমনকি কোন কোন পণ্যে সুবিধা দেয়া হয়েছে, তার কোনো তালিকাও পাননি।
এ বিষয়ে ঢাকায় বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমিও তালিকাটি খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। সুবিধার আওতায় কী ধরনের পণ্য আছে, সেটা সবার জানার অধিকার আছে।’ তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দ্রুত তালিকাটি এনে প্রকাশ করার আহ্বান জানান।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এতদিন আমরা চায়নার মার্কেটে মাত্র ৬১ থেকে ৬২ শতাংশ পণ্যে ডিউটি ফ্রি (শুল্কমুক্ত) সুবিধা পেতাম। কিন্তু এখন তারা ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। চীনের মতো পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে এ সুবিধা পাওয়ায় আমাদের সম্ভাবনার পরিমাণটাও বেড়ে গেছে।
সম্ভাবনার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘চীনের মোট বাজারের মধ্যে বাংলাদেশ মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ দখল করতে পেরেছে। অথচ ভিয়েতনামের দখলে রয়েছে চীনের মোট বাজারের ৩ শতাংশ। বাংলাদেশও এ সুবিধা কাজে লগিয়ে চীনের বাজারে বেশি বেশি পরিমাণ পণ্য পাঠাতে পারবে।’
চীনের শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগানোর সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের সব বিভাগ কাজ করছে। আশা করি, খুব শিগগিরই কী ধরনের পণ্যে সম্ভাবনা রয়েছে সেটি জানাতে পারব। একটু লেট (দেরি) হলেও এক্ষেত্রে আমাদের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে এবং সেটি আমরা কাজে লাগাতে পারব। এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি।’
এমইউএইচ/এমএআর/পিআর