বিশেষ প্যাকেজ : শিল্প ও সেবা খাতে বাড়ছে ঋণের চাহিদা
>> ইতোমধ্যে সাত হাজার ১৯১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ
>> ৬৪০ গ্রাহকের মধ্যে ২৭ ব্যাংকের এই ঋণ বিতরণ
>> নির্ধারিত সময়ে প্যাকেজ বাস্তবায়ন, আশা ব্যাংকগুলোর
করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের শিল্প ও সেবা খাত। এসব খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরিয়ে আনতে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। সরকারের এ ঋণ সুবিধা নিতে ইতোমধ্যে সহস্রাধিক ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা আবেদন করেছেন। বড় বড় অনেক উদ্যোক্তা ভর্তুকি সুদে এ ঋণ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ফলে বেড়েছে চাহিদা। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঋণ সুবিধা পেতে বিভিন্ন শর্ত পরিপালনে ভোগান্তির কথাও জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকে গত ১৩ জুলাই পর্যন্ত ২৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৬৪০ গ্রাহকের কাছে সাত হাজার ১৯১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ঘোষিত লকডাউনের কারণে প্রায় বন্ধ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। বাধাগ্রস্ত হয় উৎপাদন কার্যক্রম। ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবারও পুরোদমে কাজ শুরু করছে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ কারণে শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণের চাহিদা বেড়েছে।
করোনাভাইরাসে ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতে চলতি মূলধন বাবদ ঋণসুবিধা দেয়ার জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। প্রথমে ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব উৎস থেকে এ ঋণ দিতে বলা হলেও পরে দ্রুত প্যাকেজ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো এই ঋণের বিপরীতে ৯ শতাংশ সুদ পাবে। এই সুদের অর্ধেক তথা সাড়ে ৪ শতাংশ ভর্তুকি দেবে সরকার। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ নেয়া হবে গ্রাহকের কাছ থেকে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ বিতরণ দ্রুত সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি নিয়ন্ত্রণ সংস্থার এক নির্দেশনায়, শিল্প ও সেবা খাতের ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা চলতি জুলাই ও আগামী আগস্টের মধ্যে বিতরণ সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব নির্দেশনা দেয়া হয়। পরে ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্বই অচল ছিল। প্রথমদিকে ঋণের চাহিদা কম ছিল। এখন অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে অর্থনীতি সচল হতে শুরু করেছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য চাঙা হচ্ছে। কলকারখানা চালু হয়েছে। ফলে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ঋণের চাহিদাও বেড়েছে।
চলতি মাসেই শিল্প খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়ে যাবে— জানিয়ে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন- এবিবি’র সাবেক এ সভাপতি বলেন, পোশাক খাতের বেতন-ভাতার পাঁচ হাজার কোটি টাকা এ প্যাকেজের আওতায় এসেছে। ইতোমধ্যে ভালো অঙ্কের ঋণ বিতরণও হয়েছে। সব মিলিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ দেয়া সম্ভব হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজগুলো ঘোষণা করেছে তা ব্যাংকনির্ভর। আবার ব্যাংকগুলোর নিজস্ব কিছু পলিসি আছে। সেই পলিসি অনুযায়ী তারা ঋণ দেবে। তারা তাদের নিজস্ব গ্রাহকের বাইরে অন্য কাউকে ঋণ কম দেবে। আবার ঝুঁকি বিবেচনায় নতুন উদ্যোক্তাদের তারা ঋণ দিতে চাইবে না। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা যেন ঋণ পায় সেদিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি ঋণ বিতরণ ও আদায়ে কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সজাগ দৃষ্টিও রাখতে হবে।
প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, কোভিড-১৯ এর কঠিন সময়েও আমরা রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ঝুঁকি নিয়েও বাস্তবায়ন করেছি। পরবর্তীতে শিল্প ও সেবা খাত, সিএমএসএমই খাতসহ বিভিন্ন প্যাকেজ এসেছে, সেগুলো এখন চলমান। আশা করছি, সরকার যে সময় দিয়েছে নির্ধারিত সময়েই ঋণ দেয়া সম্ভব হবে।
প্যাকেজের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে— এমন অভিযোগ বেশকিছু ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার। এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, করোনার মতো পরিস্থিতির মধ্যে আগে কখনও আমরা পড়িনি। নতুন নতুন সমস্যা ও সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। আমাদের অনেকে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। আবার অনেকে উপসর্গ নিয়ে নিয়মিত অফিস করতে পারেননি। এসব কারণে প্রথমদিকে কিছুটা সমস্যা হয়েছে।
‘এছাড়া ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে সময় লাগছে। তারপরও যত দ্রুত সম্ভব ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে’— বলেন তিনি।
অগ্রণী ব্যাংক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে সবধরনের উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে শামস-উল ইসলাম আরও বলেন, সরকার ঘোষিত প্যাকেজের অংশ হিসেবে প্রথমদিকে রফতানিমুখী পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতার ৬৫ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছি। এতে কোনো সমস্যা হয়নি। শিল্প ও সেবা খাতে ২৫০ কোটি টাকার মতো ঋণের অনুমোদন হয়েছে। বেশকিছু ঋণ প্রক্রিয়াধীন অবস্থায়ও আছে।
এসআই/এমএআর/পিআর