কৃষি ঋণে অনীহা প্রমাণ হলে ব্যাংক ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
কৃষি ঋণ বিতরণে অনীহা বা সহযোগিতা না করার সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে দায়ী ব্যাংক ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কৃষিতে উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কৃষি খাতে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির জন্য আগামী ১ বছর সুদভর্তুকি দেবে সরকার। কৃষকরা ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন। আর ৫ শতাংশ সুদ ভর্তুকি হিসেবে ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করবে সরকার। এ ছাড়া কৃষি খাতের ঋণের অন্তত ৬০ শতাংশ শস্য খাতে দিতে হবে। তবে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী কৃষকদের সেবা দিতে এগিয়ে আসেনা ব্যাংকগুলো।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাভাইরাসে কৃষি খাতের ক্ষতি মোকাবেলার পাশাপাশি আগামীতে খাদ্যের উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নানা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। কৃষকদের অনুকূলে ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খাতে ঋণ বিতরণে সুদ ভর্তুকি ছাড়াও নানা সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হচ্ছে। তারপরও ব্যাংকগুলোর মধ্যে কৃষি ঋণ বিতরণে অনীহা দেখা যাচ্ছে।
এ কারণে প্যাকেজের আওতায় কৃষি ঋণ বিতরণ বাড়াতে গত মাসের শেষ সপ্তাহে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এরপরেও এই প্যাকেজের আওতায় চলতি মূলধন, শস্য ও ফসল খাতে কৃষিঋণ বিতরণ করছে না ব্যাংকগুলো। এমন অবস্থায় কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কৃষিতে ঋণ বিতরণে কোনরূপ অনীহা বা শৈথিল্য প্রদর্শন এবং সহযোগিতা না করার সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে দায়ী ব্যাংক বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।
এ বিষয়ে সতর্ক করে ১ জুলাই ৪৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে চিঠি পাঠিছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, 'নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট আর্থিক সংকট মোকাবেলায় প্রণোদনা সুবিধার আওতায় কৃষকের অনুকূলে ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে বর্ণিত খাতসমূহ চলতি মূলধন এবং শস্য ও ফসল খাতে ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদে কৃষিঋণ বিতরণে কোনো অনীহা প্রদর্শন এবং অসহযোগিতা করা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। এ ধরনের জাতীয় সংকটকালে সরকারের পাশাপাশি ব্যাংকই সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া কৃষি খাতে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল বরাদ্দসহ সুদ ভর্তুকি প্রদানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপরন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতি-সহায়তা প্রদানের পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে।'
'এমতাবস্থায় স্বচ্ছতা ও হয়রানিমুক্তভাবে প্রণোদনা সুবিধার আওতায় ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম থেকে চলতি মূলধন এবং শস্য ও ফসল খাতে কত কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য আগামী ৭ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগে প্রদান করার পরামর্শ দেওয়া হলো।'
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক অশোক কুমার দে জানান, ব্যাংকগুলোর মাঝে কৃষিঋণ বিতরণে অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ কারণেই সতর্কতামূলক এই চিঠি। এই প্যাকেজের আওতায় বিতরণকৃত ঋণের তথ্য রাখার জন্য কৃষিঋণ বিভাগে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। তারা প্রতি সপ্তাহে ঋণ পরিস্থিতির আপডেট রাখবে। প্রতিটি ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং কৃষি ঋণ বিতরণ কার্যক্রম মনিটরিং করবে। এতে কোনো ব্যাংকের অনীহা বা অসহযোগিতা দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর এ অনীহার কারণে দুই দফায় নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে সার্কুলার জারি করে জুলাইয়ের মধ্যে বেশিরভাগ এবং আগস্টের মধ্যে প্যাকেজের পুরো টাকা বিতরণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকগুলোকে আগেই লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। গভর্নর ফজলে কবির অনলাইনে বৈঠকে করে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ঋণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে ঋণ বিতরণের অগ্রগতি জানতে তদারকি বাড়ানোর অংশ হিসেবে প্রতি ১৫ দিন পর পর তথ্য জানাতে নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে মাসিকভিত্তিতে জানানোর নির্দেশনা ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের মার্চে কৃষি খাতে ৩ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা ঋণ দেয় ব্যাংকগুলো, যা আগের বছরের মার্চের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। গত বছরের এই মাসে ৬ হাজার ২২২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। পরের মাস এপ্রিলে কৃষিঋণ বিতরণে ধস নামে। এপ্রিলে মাত্র ৪৯৬ কোটি টাকা ঋণ দেয় ব্যাংকগুলো। আগের বছর একই সময় ঋণ দেয় ২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এপ্রিলে ঋণ বিতরণ কমে প্রায় ৭৯ শতাংশ। এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে ঋণ বিতরণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। তবে তা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ বিতরণ কমেছে ৩৭ শতাংশ। আগের বছরে মে মাসে ব্যাংকগুলো কৃষি খাতে ১ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে। সব মিলিয়ে লকডাউনের ৩ মাসে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলো ৫ হাজার ৮৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। যা আগের বছরের একই সময়ে চেয়ে ৫০ দশমিক ৫৮ শতাংশ কম। আগের বছরের এই তিন মাসে ঋণ দেয় ১০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২৪ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। কিন্তু ১১ মাসে (জুলাই-মে) বিতরণ করেছে ১৮ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এক মাসে ৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করতে হবে। এ ছাড়া আগের বছরের আলোচ্য ১১ মাসে ব্যাংকগুলো কৃষি খাতে ঋণ দেয় ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এই হিসেবে ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ।
এসআই/এনএফ/জেআইএম