করোনায় আক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্ধশতাধিক কর্মী
>> পরিস্থিতির অবনতি হলে অফিসের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা
>> রোস্টারিং ডিউটি চান ব্যাংকাররা
>> প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ রোধে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বাতির নিচে অন্ধকার! যারা নির্দেশনা দিচ্ছে তাদের ঘরেই বেহাল দশা। স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মীরা। ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। উপসর্গ দেখা দিয়েছে শতাধিক কর্মীর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতির অবনতি হলে বিকল্প কর্মীর অভাবে সংকট মুহূর্তে অফিস চালানো দুরূহ হয়ে পড়বে। স্থবির হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম। এতে করে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হবে। তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল ও নিরবছিন্ন সেবার জন্য স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনসহ কর্মীদের রোস্টারিং ডিউটির ব্যবস্থা করা জরুরি বলছেন কর্মকর্তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার কর্মী বাংলাদেশ ব্যাংকে আসছেন। গাড়িতে পাশাপাশি বসে অফিসে আসতে হচ্ছে। প্রধান ফটক দিয়ে একসঙ্গে ঢুকছেন। লিফটে গাদাগাদি করে সবাই একসঙ্গে উঠছেন। আবার অফিসে একসঙ্গে বসে কাজ করতে হচ্ছে। অনেক লোকের সমাগম এখানে। তাই চাইলেও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা যাচ্ছে না।
তারা বলছেন, করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে। একজন থেকে শতজনের শরীরে ছড়ায়। এখন যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অফিস চলছে, এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ভয়াবহ রূপ নেবে। ব্যাংকের অধিকাংশ কর্মী কোভিড-১৯-এ সংক্রমিত হবেন। তখন অফিসের কার্যক্রম চালানো দুরূহ হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কর্মকর্তার উপস্থিতি কমিয়ে কাজ করানোর জন্য। যারা বাসায় বসে কাজ করতে পারবেন তাদের অফিসে আসতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে সব কর্মকর্তা কাজ করছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতি গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। যেমন-ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ, ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইট সুপরভিশন, বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ, পেমেন্ট সিস্টেসম। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব বিভাগের কর্মকর্তারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে বিভাগ লাকডাউন করা হবে। তখন পুরো ব্যাংকিং খাতের কার্যক্রমে তার প্রভাব পড়বে। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত এখনই বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেয়া। অর্থাৎ কর্মীর উপস্থিতি কমাতে হবে। কর্মীদের তিন-চার স্তরে ভাগ করে পর্যায়ক্রমে কাজ করাতে হবে। এতে করে কোনো বিভাগের একজন আক্রান্ত হলে তার কাজ অন্যজনকে দিয়ে যেন করানো যায়।
এদিকে করোনাভাইরাসের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা ও কর্মীদের সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক ভিত্তিতে রোস্টারিং ডিউটি ব্যবস্থা করা দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল।
গত ১ জুন গভর্নর ফজলে কবিরকে দেয়া ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের চিঠিতে বলা হয়েছে, করোনার সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত দীর্ঘ সাধারণ ছুটি শেষে গত ৩১ মে অফিস কার্যক্রম পুরোমাত্রায় চালু করা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, অফিস চালু হওয়ার পর অফিসের প্রধান ফটক, ভবনের ফটক, লিফট, করিডোরে মানবজট তৈরি হচ্ছে। স্টাফ বাসে গা ঘেঁষে বসে কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অফিসে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে লিফটের জন্য অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীরা
‘করোনা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা যেমন-গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসে করে যাতায়াতের দীর্ঘসময় ভ্রমণে কর্মকর্তাদের সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়ছে। অনেক বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয়সংখ্যক আসন চেম্বার না থাকায় একই কম্পিউটারে একাধিক কর্মকর্তাকে কাজ করতে হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে অফিসের কাজে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক গুরুত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আরও অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার উপসর্গ দেখা দিয়েছে। যারা করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন, ফলাফল এখনও তাদের হাতে পৌঁছায়নি। তবে অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গ প্রকাশ পায় না বিধায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা আরও অধিক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল বলছে, করোনাভাইরাস ভয়াবহ রকমের ছোঁয়াচে রোগ। কাজেই সামাজিক দায়িত্ব নিশ্চিতসহ স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি অনুসরণ না করলেও অফিসে কার্যক্রম অব্যাহত রাখায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছেন। এছাড়া বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক-দুজন আক্রান্ত হলে ওই বিভাগের একাধিক কর্মকর্তাকে আইসোলেশনে যেতে হবে। এক্ষেত্রে বিকল্প কর্মকর্তার না থাকলে ওই বিভাগ অফিস কার্যক্রম পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের করোনাভাইরাস মুক্ত রেখে আর্থিক খাত নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখার জন্য ১৯ মার্চ থেকে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তাদের ১৫০ জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছে ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বরাত দিয়ে ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল বলছে, সংক্রমণের ঝুঁকি যতটা সম্ভব কমিয়ে কর্মীদের নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে হবে। কোন কর্মী আগে কাজে ফিরবেন তা নির্ধারণ করার পাশাপাশি যারা ঘরে থেকে কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন তাদের ঘরে থেকেই কাজ করতে হবে।
সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণপূর্বক অফিস আদালত পরিচালনা করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেবল আবশ্যকীয় কাজগুলো চালিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ পদক্ষেপের অংশ হিসেবে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চার ভাগে ভাগ করে পাঁচভাগের একভাগ কর্মকর্তার উপস্থিতির মাধ্যমে কর্ম সম্পাদনের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলেছে ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল।
এমন প্রেক্ষাপটে করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যাপ্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং অফিস, বিভাগ, সেকশন কর্মকর্তাদের দু-তিন ভাগে ভাগ করে সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক আবর্তনের মাধ্যমেও অফিস পরিচালনার বিষয়ে গভর্নরের কাছে দাবি জানিয়েছে অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। শিগগিরই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
এসআই/এসআর/জেআইএম