করোনার থাবায় বহুজাতিক কোম্পানিতে নেই ছয় হাজার কোটি টাকা
ডেটল, মরটিন, হারপিক, ভ্যানিশ, লাইজল, ভিটসহ কয়েকটি প্রসাধনপণ্যের কল্যাণে বাংলাদেশে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে রেকিট বেনকিজার। দেশের পুঁজিবাজারে বহুজাতিক এই কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হয় ১৯৮৭ সালে। ভালো ব্যবসার পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ দেয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার বরাবরই বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
বছরের পর বছর ভালো ব্যবসা করা এবং মোটা লভ্যাংশ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করায় দামের দিক থেকে কোম্পানিটির শেয়ার এখন সবার ওপরে। এমন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই কোম্পানিটির ওপর থেকেই বিনিয়োগকারীদের আস্থায় যেন চিড় ধরিয়ে দিয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস। ফলে বাংলাদেশে করোনার ছোবল পড়তেই দফায় দফায় দরপতন হয়েছে কোম্পানিটির শেয়ার দামে।
রেকিট বেনকিজারসহ এক ডজন বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে আছে- ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন, ম্যারিকো বাংলাদেশ, লিন্ডে বাংলাদেশ, বাটা সু, লাফার্জহোলসিম, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, আরএকে সিরামিকস, সিঙ্গার বাংলাদেশ এবং গ্রামীণফোন। ভালো ব্যবসার পাশাপাশি ভালো মুনাফা করায় এ কোম্পানিগুলোর ওপর বিনিয়োগকরীদের বেশ আস্থা রয়েছে। তবে প্রাণঘাতী করোনার আতঙ্কে এর কোনোটিই দরপতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এরপর সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগে শেয়ারবাজারে লেনদেন হয় ২৫ মার্চ পর্যন্ত। অর্থাৎ করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর মার্চে শেয়ারবাজারে লেনদেন হয় ১২ কার্যদিবস। এই ১২ কার্যদিবসেই তালিকাভুক্ত ১২টি বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা সম্মিলিতভাবে হারিয়েছেন ছয় হাজার ২৯৫ কোটি ২৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা। শেয়ারের দাম কমার কারণে বিনিয়োগকারীরা এই ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
অবশ্য ৯ মার্চ থেকে শেয়ারবাজারে একের পর এক বড় ধস নামায় ১৯ মার্চ শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস (যে দামের নিচে নামতে পারবে না) নির্ধারণ করে দিয়ে নতুন নিয়মের সার্কিট ব্রেকার চালু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এতে একদিকে শেয়ার দরপতন আটকানো হয়, অন্যদিকে ৯ মার্চ লেনদেন শুরুতেই প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। যদি নতুন সার্কিট ব্রেকার না আনা হতো তাহলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমার পরিমাণ বাড়ত এবং বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পরিমাণও কয়েকগুণ বেশি হতো।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বের সব শেয়ারবাজারেই টালমাটাল অবস্থা। করোনাভাইরাস যেভাবে সারাবিশ্বে ত্রাস ছড়াচ্ছে তাতে শুধু শেয়ারবাজার না সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কবে করোনার হাত থেকে বিশ্ব মুক্তি পাবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। দিন যত যাচ্ছে করোনার প্রকোপ তত বাড়ছে। এ নিয়ে সব ধরনের বিনিয়োগকারীর মধ্যেই আতঙ্ক বিরাজ করছে। যে কারণে ভালো মৌলভিত্তির হওয়ার পরও করোনা আতঙ্কে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতন হয়েছে।
তথ্য পর্যালোচনা দেখা যায়, বাংলাদেশ করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে শেয়ারপ্রতি দাম সব থেকে বেশি কমেছে রেকিট বেনকিজারের। কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ১৪৬ টাকা ৮০ পয়সা। তবে স্বল্প মূলধনের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সম্মিলিতভাবে কোম্পানিটির শেয়ার দাম কমার পরিমাণ তুলনামূলক কম। ৪৭ লাখ ২৫ হাজার শেয়ারের এই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম সম্মিলিতভাবে কমেছে ৬৯ কোটি ৩৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ারের দাম সম্মিলিতভাবে সব থেকে বেশি কমেছে গ্রামীণফোনের। ৯ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার দাম সম্মিলিতভাবে কমেছে তিন হাজার ৬৩২ কোটি ৩০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। আর প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ২৬ টাকা ৯০ পয়সা।
এরপরই রয়েছে বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত ভালো লভ্যাংশ দেয়া ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ। করোনার প্রকোপের মধ্যে এই কোম্পানিটির শেয়ার দাম সম্মিলিতভাবে কমেছে এক হাজার ৮০ কোটি টাকা। আর প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ৬০ টাকা।
প্রতিটি শেয়ারের দাম তিন টাকা ১০ পয়সা কমলেও বড় মূলধনের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের শেয়ার দাম সম্মিলিতভাবে কমেছে ৩৬০ কোটি দুই লাখ ৫৭ হাজার টাকা। ফলে শেয়ার দাম সম্মিলিতভাবে সর্বোচ্চ কমার দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয় স্থান দখল করেছে।
নিয়মিত মোটা লভ্যাংশ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো বার্জার পেইন্টস, ম্যারিকো বাংলাদেশ, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন, সিঙ্গার বাংলাদেশ, লিন্ডে বাংলাদেশ এবং বাটা সু’র মতো কোম্পানিও বড় পতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। করোনা প্রকোপের মধ্যে বার্জার পেইন্টসের শেয়ার দাম সম্মিলিতভাবে কমেছে ২৯৭ কোটি ৭৪ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। আর প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ৬৪ টাকা ২০ পয়সা।
ম্যারিকো বাংলাদেশের প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ৮২ টাকা ৯০ পয়সা। এতে কোম্পানিটির শেয়ার দাম সম্মিলিতভাবে কমেছে ২৬১ কোটি ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ৬৬ টাকা ৬০ পয়সা। এতে শেয়ারের দাম সম্মিলিতভাবে কমেছে ৮০ কোটি ২২ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। আর সিঙ্গার বাংলাদেশের প্রতিটি শেয়ারের দাম ২০ টাকা ১০ পয়সা কমায় সম্মিলিতভাবে কমেছে ২০০ কোটি ৪০ লাখ ২৭ হাজার টাকা।
লিন্ডে বাংলাদেশের প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ৫১ টাকা ২০ পয়সা। ফলে সম্মিলিতভাবে শেয়ারের দাম কমেছে ৭৭ কোটি ৯১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। আর বাটা সু’র শেয়ার দাম সম্মিলিতভাবে কমেছে ৭৩ কোটি ৩২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ৫৩ টাকা ৬০ পয়সা।
এছাড়া হাইডেলবার্গ সিমেন্টের শেয়ার দাম সম্মিলিতভাবে কমেছে ৯৪ কোটি ৩৬ লাখ ৯ হাজার টাকা। কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ১৬ টাকা ৭০ পয়সা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে সব থেকে দুর্বল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত আর এ কে সিরামিকসের প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে এক টাকা ৬০ পয়সা। এতে শেয়ারের দাম সম্মিলিতভবে কমেছে ৬৮ কোটি ৪৭ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।
এসব বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগ শেয়ার বিদেশিদের কাছে রয়েছে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে তেমন একটা নেই। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিক্রির কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমেছে। করোনাভাইরাসের কারণেই বিদেশিদের এই বিক্রির চাপ এসেছে।
ডিএসইর আরেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন জাগো নিউজকে বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মৌলভিত্তির প্রতিষ্ঠান। ভালো ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরাই মূলত এর ক্রেতা। করোনার কারণে সারাবিশ্বে মহামারি বিরাজ করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অত্যন্ত দ্রুতগতির বিনিয়োগকারী। তারা আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় না, তারা যুক্তি ও বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেয়। মহামারির আশঙ্কা দেখে তারা বিগত দুই মাস ধরে শেয়ার বিক্রি বাড়িয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে সামনের দিনগুলো খারাপ হবে।
এমএএস/বিএ/জেআইএম