দ্রব্যমূল্যে পিষ্ট নিম্ন আয়ের মানুষ
দুই সন্তানের জনক রিকশাচালক মিরাজ। পরিবার নিয়ে ভাড়ায় থাকেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে দিনে তার আয় হয় ৬০০-৭০০ টাকা। এ টাকা দিয়েই মেটাতে হয় পরিবারের চার সদস্যের ভরণ-পোষণসহ অন্যান্য খরচ।
মাসে টিন শেডের দুই রুমের ভাড়া ৮ হাজার টাকা। পরিবারের চার সদস্যের জন্য মাসে চাল লাগে দুই হাজার টাকার ওপরে। মাছ-মাংস বাদেই কাঁচাবাজারের পেছনে খরচ হয় আরও প্রায় তিন হাজার টাকা। সব মিলিয়ে সংসার চালাতে তার মাসে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকার ওপরে।
খরচের এই লাগাম টেনে স্কুল পড়ুয়া দুই সন্তানের চাহিদা খুব একটা পূরণ করতে পারেন না মিরাজ। এরপরও স্বপ্ন দেখেন ছেলে-মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। সংসার ও ছেলে-মেয়ের খরচের ঘানি টানতে বেশিরভাগ দিনই দুপুরে না খেয়ে কাটিয়ে দেন তিনি।
মিরাজ বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে যে আয় করি তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। চাল, ডাল, তেল, চিনির যে দাম স্ত্রী, ছেলে, মেয়ের মুখে তিন বেলা খাবার তুলে দেয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি নিজে দুপুরের খাবার ছেড়ে দিয়েছি। তারপরও খরচের হিসাব মিলাতে পারি না।
শুধু মিরাজ নয়, রাজধানীতে বসবাস করা একটি বড় অংশেরই জীবনযাত্রার চিত্র এটি। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে অনেক কর্মজীবীই দুপুরে ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। গত এক সপ্তাহে রাজধানীতে বসবাসরত রিকশাচালক, বীমাকর্মী, বেসরকারি চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কমপক্ষে ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, এ বিষয়ে গত এক সপ্তাহে এ প্রতিবেদক যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের প্রত্যেকেই বলেছেন, মাসে এক থেকে দুই বারের বেশি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এদের মধ্যে ১৫ জন জানিয়েছেন তারা দুপুরে ভারি খাবার ছেড়ে দিয়েছেন। ১০ জন জানিয়েছেন মাসের খরচ মেটাতে অন্যের কাছ থেকে অর্থ ধার করেছেন।
বেসরকারি একটি জীবন বীমা কোম্পানিতে অফিসার পদে কাজ করেন রায়হান। তিনি জানান, পরিবারসহ দুই সন্তান নিয়ে গোপীবাগের একটি ভাড়া বাসায় তার বসবাস। দুই সন্তানই স্কুলে পড়ে। বড় ছেলে পঞ্চম শ্রেণীতে এবং ছোট সন্তান তৃতীয় শ্রেণীতে।
তিনি বলেন, সারা মাসে যে আয় করি সংসার চালাতেই তার সব খরচ হয়ে যায়। মাস শেষে কোনো টাকাই জমা থাকে না। আর গত কয়েক মাস ধরে যে হারে খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়ছে তাতে ঠিকমত সংসার চালানোই দুরুহ হয়ে পড়ছে। গরুর মাংস খাওয়া অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। মাঝে মধ্যে ব্রয়লার মুরগি কেনা হয়। তবে মাসে ২-৩ দিনের বেশি নয়।
রায়হান আরও বলেন, মাংসের কথা বাদ দিন। ঠিকমত সবজিও কিনে খাওয়ার উপায় নেই। এই শীতের মধ্যেও সব সবজির দাম চড়া। একটি ফুলকপি কিনতে ৩০ টাকার ওপরে লাগে। টমেটোর কেজি ৫০ টাকার ওপরে। পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা। এতো দামে পছন্দ মতো সবজি কিনে খাওয়া সম্ভব নয়।
একটি গার্মেন্টস কারাখানার কর্মী মিলা থাকেন রামপুরার একটি টিন শেডের বাসায়। কারখানা থেকে মাসে বেতন পান ১২ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে নিজের খাওয়া ও অন্যান্য খরচ মিটিয়ে গ্রামের বাড়িতেও প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাতে হয় তাকে।
এই গার্মেন্টসকর্মী বলেন, মাসে যে বেতন পাই, তা দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। বেশিরভাগ দিন দুপুরে কিছু খাই না। মাঝে মধ্যে বেশি ক্ষিধে লাগলে সিঙ্গারা অথব বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দেই। আমরা যে কী কষ্টে আছি তা বলে বোঝাতে পারবো না ভাই। মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই। আলু, ভর্তা-ডিম ভাজি দিয়ে পেট ভরে ভাত খাব তারও উপায় নেই। এক কেজি চাল কিনতে লাগে ৪০ টাকা। একটি ডিমের দাম ৯ টাকা। আলুর কেজি ৩০ টাকা। এবার আমার কী অবস্থা, তা একটু চিন্তা করেই বুঝে নেন।
বেড়েই চলেছে চাল, ডাল, তেল, চিনির দাম
সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, এক মাস আগের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেড়ে বর্তমানে এক কেজি সরু চালের দাম দাঁড়িয়েছে ৫০-৬০ টাকা। মোটা চালের দামও মাসের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। বর্তমানে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৩-৩৫ টাকায়।
চালের পাশাপাশি আটা, তেল, ডাল, চিনিসহ সব ধরনের নিত্য পণ্যের দাম বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে আটার দাম কেজিতে ১৩ শতাংশ বেড়ে ২৬-৪৫ টাকায় উঠেছে। খোলা সয়াবিন তেলের দাম প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ বেড়ে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকা। পাম অয়েলের দাম ১৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রতিলিটার বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকা। মসুর ডালের দাম প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ বেড়ে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-১৩০ টাকায়। এক কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকা।
মসলার বাজার গরম
পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম এখনো ভোগাচ্ছে দেশবাসীকে। রাজধানীর বাজারগুলোতে ১০০ টাকার নিচে মিলছে না দেশি নতুন পেঁয়াজের কেজি। আমদানি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা। টিসিবির হিসাবে, বছরের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম ৩১১ শতাংশ এবং আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ২১১ শতাংশ বেড়েছে। রসুনের দাম বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৮৭ শতাংশ। বর্তমানে আমদানি করা রসুন কেজি ১৩০-১৫০ টাকা এবং দেশি রসুন ১৪০-২০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এক মাস ধরেই রসুনের এমন চড়া দাম।
শুকনো মরিচের দাম মাসের ব্যবধানে ১৪ শতাংশ এবং বছরের ব্যবধানে সাড়ে ৪২ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২২০-৩৫০ টাকা কেজি। আদার কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০-১৫০ টাকা। বছরের ব্যবধানে এ পণ্যটির দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশ। জিরার দাম বছরের ব্যবধানে ৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৫-৪৫০ টাকা কেজি। দারুচিনির দাম ৩৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪২০-৪৫০ টাকা কেজি। আর এলাচের দাম বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়ে ৫ হাজার টাকা কেজি হয়েছে।
স্বস্তি নেই সবজিতে
শিম, টমেটো, গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগমসহ শীতের সবজি বাজারে ভরপুর থাকলেও বেশিরভাগ সবজির দাম এখনো বেশ চড়া। শসা ৪০-৬০ টাকা, পেঁপে ৪০-৬০ টাকা, করলা ৫০-৭০ টাকা, দেশি পাকা টমেটো ৪০-৬০ টাকা, শিম ৪০-৫০ টাকা, গাজর ৪০-৫০ টাকা, মুলা ২০-২৫ টাকা, নতুন গোল আলু ২৫-৩০ টাকা, শালগম ৩০-৪০ টাকা, বেগুন ৪০-৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। শীতের অন্যতম সবজি ফুলকপি ও বাধাকপি বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা প্রতি পিস।
আয়-ব্যয়ের তথ্য
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের খানা (একই রান্নায় খাওয়া এবং একসঙ্গে বসবাস) আয়-ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে, খানাপ্রতি মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা, যা ২০১০ সালে ছিল ১১ হাজার ৩৫৩ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে খানাপ্রতি মাসিক আয় বেড়েছে ৪ হাজার ৫৯২ টাকা বা ৪০ শতাংশ হারে।
অপরদিকে ২০১৬ সালের হিসাবে খানাপ্রতি মাসিক ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯১৫ টাকা, যা ২০১০ সালে ছিল ১১ হাজার ২০০ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে খানাপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ৪ হাজার ৭১৫ টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির এ হার ৪২ শতাংশ।
এরপর বিবিএস’র খানা আয়-ব্যয়’র আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৬ সালের তুলনায় বর্তমানে ব্যয়ের পরিমাণ যে বেশ বেড়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০১৯ সালে ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ শতাংশ। আগের বছরেও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হার একই ছিল। এ হিসাবে দুই বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১২ শতাংশের ওপরে।
এমএএস/এইচএ/পিআর