‘বিতর্কিত’ ব্যক্তিকে এমডি করতে মরিয়া ডিএসই
ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে বিতর্কিত ব্যক্তিকে বেছে নিচ্ছে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। অনিয়মের অভিযোগ থাকা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী সানাউল হককে এমডি করতে ডিএসই’র একজন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ডিএসই’র এমডি নিয়োগ-সংক্রান্ত ‘নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটিতে’ (এনআরসি) রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসই’র নতুন এমডির জন্য মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) ছয়জনকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয় । এদের মধ্যে ছিলেন আইসিবির সাবেক এমডি কাজী সানাউল হক, যমুনা ব্যাংকের সাবেক এমডি শফিকুল আলম, ন্যাশনাল ব্যাংক ও ডিএসই’র সাবেক এমডি শরিফুল ইসলাম, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি রেজাউর রহমান, জনতা ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) শরীয়ত উল্লাহ এবং গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের সাবেক সচিব ও সিএফও সারোয়ার খান।
এদের মধ্যে ডিএসই’র সাবেক এমডি শরিফুল ইসলাম এবং জনতা ব্যাংকের সিএফও শরীয়ত উল্লাহ সাক্ষাৎকার দিতে আসেননি। বাকি চারজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে ডিএসই’র নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটি কাজী সানাউল হক এবং যমুনা ব্যাংকের সাবেক এমডি শফিকুল আলমকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় রেখেছেন। আগামী বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) ডিএসই’র বোর্ড সভায় তাদের দুজনের নাম প্রস্তাব করা হবে এবং বোর্ড সভার মাধ্যমে একজনকে চূড়ান্ত করা হবে।
ডিএসই’র সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সংক্ষিপ্ত তালিকায় দুজনকে রাখা হলেও কাজী সানাউল হককেই এমডি করতে চায় ডিএসইর প্রভাবশীল একটি পক্ষ। অথচ আইসিবির এমডি থাকাবস্থায় কাজী সানাউল হকের বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ আছে, শেয়ার ব্যবসায় জড়িত যেসব ব্যক্তি ঋণ পাওয়ার যোগ্য নন তাদের ঋণ দিয়েছেন সানাউল হক। আবার যাকে ২৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার কথা তাকে কয়েক কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন তিনি। এর মাধ্যমে সরকারের ১৩৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে তলবও করে।
এ বিষয়ে ডিএসই’র একাধিক সদস্য বলেন, কাজী সানাউল হকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার বিষয়ে দুদক তদন্ত করছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হোক বা না হোক তিনি বিতর্কিত। এমন ব্যক্তিকে ডিএসই’র এমডি করার চেষ্টা চলছে বলে শুনেছি। এটা শেয়ারবাজারের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।
তারা বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজার একটি ক্রিটিক্যাল সময় পার করছে। এ মুহূর্তে ডিএসই’র এমডি হিসেবে একজন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ দরকার। কারও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য ডিএসই’র এমডি বাছাই করা ঠিক হবে না।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ডিএসই’র নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, এমডি পদের জন্য আমরা ছয়জনকে সাক্ষাৎকারে ডেকেছিলাম। এদের মধ্যে চারজন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাদের থেকে দু’জন আমরা বাছাই করেছি। এ দু’জনের নাম আগামী বৃহস্পতিবারের পরিচালনা পর্ষদ সভায় তোলা হবে। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
কোন দু’জনকে রাখা হয়েছে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটি কনফিডেনশিয়াল। তাই এখন তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। বোর্ড সভার পর সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
কাজী সানাউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি সাক্ষাৎকার দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নেবে ডিএসই। তাদের কী সিদ্ধান্ত তা তো আমি জানি না। যদি আমি ডিএসই’র এমডি হই, তারপর আমার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলা যাবে।’
আইসিবির ঋণ জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আইসিবির ঋণ জালিয়াতির যে অভিযোগ উঠেছিল তা সঠিক নয়। বিষয়টি রি-ইনকোয়ারি (পুনঃতদন্ত) করে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছিল সবাইকে আদালত থেকে খালাস দেয়া হয়েছে।
এর আগে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে দু’দফা ব্যর্থ হয় ডিএসই। ওই দুই দফায় ১৯ জন ডিএসই’র এমডি পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তাদের কাউকে ‘যোগ্য’ মনে করেননি ডিএসই’র সংশ্লিষ্টরা। ফলে প্রায় ছয় মাস ধরে ডিএসই’র এমডির পদ খালি রয়েছে।
এই শূন্যস্থান পূরণে ডিএসই কর্তৃপক্ষ তৃতীয় দফায় গত ১০ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি দেয়। এ বিজ্ঞপ্তিতে আগ্রহীদের ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে জীবন-বৃত্তান্তসহ আবেদন করতে বলা হয়। ডিএসই’র এই বিজ্ঞপ্তিতে সাড়া দিয়ে বেশ কয়েকজন এমডি পদের জন্য আবেদন করেন।
এদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, ব্যাংকার, হিসাববিদ এবং কর পরামর্শকরা ছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে বাদ দিয়ে ডিএসই কর্তৃপক্ষ ব্যাংকার, হিসাববিদ এবং কর পরামর্শক- এমন ছয় জনকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে ডিএসই’র এমডি নিয়োগ সংক্রান্ত ‘নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটি’র শেয়ারহোল্ডার পরিচালক রকিবুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা পৃথকীকরণে ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন স্কিমের পর ডিএসই’র দ্বিতীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ২০১৬ সালের ২৯ জুন নিয়োগ পান সাবেক ব্যাংকার কে এ এম মাজেদুর রহমান। তার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১১ জুলাই। তারপর থেকেই পদটি খালি রয়েছে।
ডিএসইতে এমডি পদে যোগ দেয়ার পর বিদেশ ভ্রমণ, কর্মকর্তাদের পদোন্নতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা বিতর্কের জন্ম দেন মাজেদুর রহমান। এরপরও ডিএসই’র পর্ষদ থেকে মাজেদুর রহমানকে এমডি পদে পুনরায় নিয়োগ চেয়ে বিএসইসিতে আবেদন করা হয়। তবে ডিএসই’র ওই প্রস্তাব বাতিল করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এর পরিপ্রেক্ষিতেই নতুন এমডি খোঁজা শুরু করে ডিএসই।
এ লক্ষ্যে গত ৭ আগস্ট বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএসই কর্তৃপক্ষ। এতে আগ্রহী প্রার্থীদের ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়েছিল। যেখানে ১৬ জন আবেদন করেন। তবে ওই ১৬ জনের মধ্যে কাউকেই যোগ্য মনে করেনি ডিএসই’র পর্ষদ এবং নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটি।
এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় এমডির খোঁজে বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএসই। এক্ষেত্রে আবেদন করেন তিন জন। অর্থাৎ দুই দফায় ১৯ জন ডিএসই’র এমডি পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন।
সেই দুই দফায় আবেদনকারীদের মধ্য থেকে গত ২ অক্টোবর সাত প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। পরবর্তীতে সাত জনের মধ্যে তিন জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। যাদেরকে গত ৬ অক্টোবর ডাকে ডিএসই’র পর্ষদ। তবে ওই তিন জনের মধ্যেও কাউকে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য যোগ্য মনে করেনি পর্ষদ।
এ কারণে ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ডিএসই’র পর্ষদ সভায় যোগ্য এমডির খোঁজে আবারও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১০ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
আগের ধারাবাহিকতায় তৃতীয় দফার বিজ্ঞপ্তিতেও এমডি পদে আবেদনের জন্য যোগ্যতা হিসেবে বিজনেস, ইকোনমিকস, স্ট্যাটিসটিকস, ম্যাথমেটিকস অথবা আইনে ব্যাচেলর ডিগ্রিসহ কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। আর প্রফেশনাল ডিগ্রি সিএফএ, সিএ, সিএমএ, সিএস, সিপিএ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও ১০ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। তবে ক্যাপিটাল মার্কেটের ওপরে আন্তর্জাতিক দক্ষতা সম্পন্ন প্রার্থীর ক্ষেত্রে অন্যান্য শর্ত শিথিল করা হয়।
এদিকে দফায় দফায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও এমডি নিয়োগ দিতে না পারার বিষয়টি ভালোভাবে নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ডিএসই’র মতো প্রতিষ্ঠান এমডি ছাড়া চলায় দেশের শেয়ারবাজারের সুনাম নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এ কারণে এবার এমডি পাওয়া না গেলে কমিশন শেয়ারবাজারের স্বার্থে নিজেই প্রশাসক বসাতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এমএএস/এইচএ/এমএস