ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

ব্যাংক ঋণে হাবুডুবু খাচ্ছে সরকার

প্রকাশিত: ১০:০৮ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯

আয় কম খরচ বেশি। ব্যয় ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে ব্যাংক খাত থেকে অস্বাভাবিক হারে ঋণ নিচ্ছে সরকার। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করে। কিন্তু প্রথম পাঁচ মাসেই প্রায় সমপরিমাণ অর্থ ধার হিসেবে নিয়ে ফেলেছে সরকার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সঠিক ব্যয় ব্যবস্থাপনা না থাকায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে ব্যাংক খাতের ওপর চাপ বাড়ছে। আর সরকারি ঋণের এই চাপে বেসরকারি খাতের ঋণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে হয় রাজস্ব বাড়াতে হবে, না হয় ব্যয় সংকোচন করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে গত ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে ৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা; আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ৩৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে চলতি বছরের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের স্থিতি বা পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৪৩ হাজার ৮২২ কোটি টাকা।

ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘সঠিক ব্যয় ব্যবস্থাপনার অভাবে অস্বাভাবিক হারে সরকার ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে। দুটি কারণে এটি হচ্ছে। এক, সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ নিচ্ছে। যার সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে নিচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এটি খারাপ নয়। কারণ, উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার চেয়ে ব্যাংকের ঋণ ভালো। তবে সমস্যা হচ্ছে সরকারের ঋণ নেয়ার মাত্রা অনেক বেশি। এটির কারণ, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় অনেক কমে গেছে। আর এ ঘাটতির কারণেই সরকারকে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে।’

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৫ লাখ ৩৮০ কোটি টাকা। আর ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা নেয়ার কথা। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস ৯ দিনে ঋণ নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা বা ৯৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যাবে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাবে। এতে করে কর্মসংস্থানের বাধা সৃষ্টিসহ জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এদিকে অতিমাত্রায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সঞ্চয়পত্র কেনায় নিয়মকানুন কড়াকড়ি করেছে সরকার। যার প্রভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।

এদিকে এককভাবে গত অক্টোবর মাসে নিট ৮২৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আগের বছরের একই মাসে যেখানে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। আর আগের মাস সেপ্টেম্বরে বিক্রি ছিল ৯৮৬ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৯ শতাংশের বেশি।

কিন্তু জুলাই-অক্টোবর সময়ে রাজস্ব বাবদ মোট ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আহরণ হয়েছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা।

রাজস্ব আদায় না বাড়লে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। আর সরকারের এ অস্বাভাবিক ঋণ নেয়ায় ব্যাংক খাতের চাপ সৃষ্টি করবে জানিয়ে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে বাধা সৃষ্টি হবে। তাই সরকারের ব্যাংক খাতের ঋণের ওপর না ঝুঁকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। আর যদি রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারে, তাহলে ব্যয় সংকোচন করতে হবে।’

অর্থ সংকটের কারণে আশানুরূপ বাড়ছে না বেসরকারি ঋণ। গত কয়েক মাস ধরে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিক কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের (২০১৯) অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ হয়েছে। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর আগের মাস জুলাই শেষে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, মে মাসে যা ছিল ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ।

চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করেছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। যা গেল অর্থবছরের জুন পর্যন্ত লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের (জুলাই-জুন) পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ ধরা হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ।

‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’নাম দিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে সরকার। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার।

এদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ধার করবে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা ঠিক করা হয়েছে। তবে কাঙিক্ষত রাজস্ব আদায় না হলে বিশাল এ বাজেট বাস্তবায়নে শুধু ব্যাংক ঋণ নির্ভর হলে অর্থনীতি চাপে পড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এসআই/এসআর/এমএস