ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

মন্দ ঋণে বিপাকে নতুন ৯ ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৫:৩০ পিএম, ০১ অক্টোবর ২০১৯

>> জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫০২২ কোটি
>> মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮৫৬ কোটি
>> তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬৬ কোটি
>> নতুন নয় ব্যাংকের মধ্যে তিনটির খেলাপি কমেছে
>> সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ পদ্মা ব্যাংকের

রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের নতুন ব্যাংকগুলো কার্যক্রম শুরুর পর নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় জড়িয়ে পড়ে। যাচাই-বাছাই ছাড়াই চলে ঋণ বিতরণ। ফলে সময় মতো ঋণ আদায় না হওয়ায় বাড়ছে মন্দ ঋণের (খেলাপি ঋণ) পরিমাণ।

নতুন নয় ব্যাংক হলো- মিডল্যান্ড, মেঘনা, পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স), ইউনিয়ন, মধুমতি, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, প্রবাসী উদ্যোক্তাদের এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক। নতুন করে নেয়া নানা পদক্ষেপের পরও মার্চের তুলনায় গত জুন প্রান্তিকে ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে কমেছে তিনটির।

অন্যদিকে, হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট গ্রুপসহ বিভিন্ন বড় ঋণ জালিয়াতি এবং অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুরবস্থায় পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক। জনতা, রূপালী, সোনালী, অগ্রণী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে নিয়মিত বাড়ছে মন্দ ঋণের পরিমাণ। ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৪০ থেকে ৪৭ শতাংশই মন্দ হয়ে গেছে। এতে সরকারি ওই ছয় ব্যাংকের মধ্যে চারটিই নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায়ও খেলাপি ঋণ কমবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে যেসব উদ্যোগ নিয়েছি সেগুলোর বাস্তবায়ন শুরুই করতে পারিনি। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে খেলাপি ঋণ কমবে, ব্যবসায়ীরাও উপকৃত হবেন।

খেলাপি ঋণের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা জুন ’১৯ প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিল-জুন এই তিন মাসে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।

চতুর্থ প্রজন্মের নতুন নয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খেলাপি কমাতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া খেলাপিদের দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা নিতে অনেকে আবেদন করছেন। ফলে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ খেলাপি ঋণ কমে আসবে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকগুলোর অধিকাংশের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে চতুর্থ প্রজন্মের নয় ব্যাংকের ঋলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ২২ কোটি টাকা। যার সিংহভাগই পদ্মা ব্যাংকের। এছাড়া মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল চার হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬৬ কোটি টাকা।

নতুন নয় ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ পদ্মা ব্যাংকের। ব্যাংকটির জুন প্রান্তিক শেষে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ তিন হাজার ৬১১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ, যা মার্চ প্রান্তিকে ছিল তিন হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ঋণের ৬৪ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মো. এহসান খসরু জাগো নিউজকে বলেন, ‘মার্চের তুলনায় জুনে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে, এটা ঠিক আছে। তবে আমরা বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। এটি ডিসেম্বর নাগাদ অনেক কমে আসবে।’

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকটির অবস্থা আরও খারাপ ছিল। আমরা খেলাপি কমাতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এছাড়া বিশেষ সুবিধার ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের আওতায় অনেকে আবেদন করছেন। এগুলো বোর্ডে পাঠানো হচ্ছে। পাশাপাশি খেলাপিদের ধরতে ব্যাংকের বিশেষ গোয়েন্দা সেল গঠন করা হয়েছে। তারা ঋণের টাকা আদায়ে কাজ করছেন। আশা করছি, ডিসেম্বর শেষে আমাদের খেলাপি এখন যা আছে তার অর্ধেকে নেমে আসবে। সেই লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুনে মিডল্যান্ড ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৪ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ৪১ কোটি বা ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৪৬ কোটি টাকা।

ইউনিয়ন ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ১৩ হাজার ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১৬৫ কোটি টাকা, মার্চ শেষে যা ছিল ১৪৩ কোটি। এনআরবি ঋণ দিয়েছে তিন হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১৯৮ কোটি; মার্চে ছিল ১৫৯ কোটি টাকা।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পাঁচ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৩৪৮ কোটি টাকা, যা মার্চে ছিল ২৮৩ কোটি। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক জুন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১৯৫ কোটি, যা মার্চে ছিল ১৪৭ কোটি টাকা।

এদিকে মার্চের তুলনায় গত জুন প্রান্তিকে নতুন নয় ব্যাংকের মধ্যে তিন ব্যাংকের খেলাপি কমেছে। মেঘনা ব্যাংকের তিন হাজার ৮৫ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে খেলাপি ২৪১ কোটি, যা মার্চ প্রান্তিকে ছিল ২৮৯ কোটি। মধুমতির তিন হাজার ৬১৯ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৮৫ কোটি, যা মার্চে ছিল ১৪৯ কোটি টাকা এবং সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে পাঁচ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১৩৮ কোটি, যা মার্চে ছিল ১৬১ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, নতুন ব্যাংকগুলো নতুন কিছু করতে পারেনি। অনৈতিক প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ বিতরণ করেছে। অনেকে আবার ঋণ বিতরণে পরিচালনা পর্ষদ অনৈতিক প্রভাব খাটিয়েছে- এমন অভিযোগও রয়েছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। তারা ইচ্ছামতো চলছে। পুরনো ব্যাংকগুলোর মতোই আমানত সংগ্রহ করে ঋণ প্রদান করছে। এভাবে চললে তো ভালো কিছু আসবে না। এজন্য নতুন নতুন পণ্য ও সুশাসনের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি নতুন ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন কার্যক্রমের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও বেশি নজরদারি বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহীদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করা হয়। তার বিপরীতে নতুন ব্যাংকের জন্য ৩৭টি আবেদন জমা পড়ে। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে ২০১২ সালের শুরুতে দুই দফায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের তিনটি এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য ছয়টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়। ২০১৩ সালের বিভিন্ন সময়ে নতুন নয়টি ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে।

রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংক। এটি এখন পদ্মা ব্যাংক নামে পরিচালিত হচ্ছে। সরিয়ে দেয়া হয়েছে মহীউদ্দীন খান আলমগীরকেও।

এছাড়া মহাজোট সরকারের তৎকালীন শরিক দল ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছিল ইউনিয়ন ব্যাংক, আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী এস এম আমজাদ হোসেনের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসবিএসি), প্রধানমন্ত্রীর আয়কর আইনজীবী ও কর্মসংস্থান ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম মনিরুজ্জামান খন্দকারের মিডল্যান্ড ব্যাংক, আওয়ামী লীগের রংপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমানের মেঘনা ব্যাংক (এ ব্যাংকের অন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ঢাকা-৩ আসনের সংসদ সদস্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু), ঢাকা-১২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসের মধুমতি ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার ফরাছত আলীর এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যবসায়ী ও সীমার্ক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদের নন-রেসিডেন্ট ব্যাংক (এনআরবি) এবং যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম চৌধুরীর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক।

এসআই/এমএআর/এমএস

আরও পড়ুন